ড. গণেশ চন্দ্র সাহা অংকন
দৃশ্যমান উন্নত অবকাঠামো এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নত, সমৃদ্ধ ও সক্ষম সমাজ গড়ার অঙ্গীকারই হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান যেখানে ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।
বাংলাদেশে ব্যাপক সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অবকাঠামো খাতে আওয়ামী লীগ সরকার তৈরি করেছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জাতির স্থিতিস্থাপকতা এবং সংকল্পের সাথে তাদের ৭৫ বছরের পথচলার সফলতা চিহ্নিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির মাঝখানে অবস্থিত আওয়ামী লীগ, প্রায় ৭৫ বছর ধরে দেশের ভিতরে ও বাইরের অনেকগুলি ঘাত প্রতিঘাত মোকাবিলা করেছে দলটি। আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের পথচলার সোনালী অর্জনের সমার্থক বাংলাদেশের নাম।
শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তাদের সত্তার এক অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশ যে কতটুকু উন্নত হয়েছে এবং সমৃদ্ধির দিকে কেমন পথে অগ্রসর হয়েছে। এই দলের যোগ্য নেতৃত্বে বাড়ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং উন্নতির ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন প্রযুক্তি। যেখানে বিশেষভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের জন্যও একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ প্রবৃদ্ধির চর্চা শুরু করেছে দলটি।
এরই ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক প্রযুক্তির দিকে উন্নত অগ্রগতি ও সুরক্ষিত জনসংযোগের মানসে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনে তাদের নতুন পথের অবকাঠামো তৈরির কাজ চলমান। এই রাষ্ট্র ও জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগের নিরলস লড়াই চলমান রয়েছে। সংগ্রাম ও স্নেহ-ভালোবাসায় একাকার হয়ে, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ- এক অপরের হৃদয়ের স্পন্দনে পরিণত হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের একটি উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা অনুসরণ করে। পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে।
বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং অন্যান্য মেগা প্রকল্পের অর্থায়নের মাধ্যমে ইনফ্রাস্ট্রাকচারে উন্নতি হচ্ছে, যা দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি দিচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশের এ সকল প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশটি একটি উন্নত অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে, এই প্রকল্পগুলি দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের সরকারের কার্যক্রম, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদেশি বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়গুলি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের করা তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক-২০২৩ এ ১৪ ধাপ উন্নতি করেছে, যা দেশকে একটি দারিদ্র্যমুক্ত এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
জিডিপি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হারে কমিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ: ১৯৭২-৭৩ সালে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৩ সাল শেষে মোট জিডিপি ৪২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত প্রকষেপিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায় যা ২০২৩ এ এসে দাঁড়ায় ১৮.৭ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের হার।
বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের ফলে তৈরি পোশাক, খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি উভয়ই সম্ভব হচ্ছে।
বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে বৈদেশিক সহায়তা ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়নে কোনো সমস্যাই হয় না। এ ছাড়া বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগেও আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হচ্ছে ।
রপ্তানি আয়ের পরিস্থিতি: বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আগ্রহজনক উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছে জাতি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ৪২ বিলিয়ন (৪,২০০ কোটি) ডলার ছিল। করোনাকালীন ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল, তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় অনুমিত ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে অনুমিত ছিল।
এছাড়া, ২০২৩ সালের অনুমিত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৫৮ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য যা আশাব্যঞ্জক বলে ধরা হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রায় দুই দশক ধরে রপ্তানি আয়ের মূল অংশ হিসেবে ৮০-৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এটি একটি অবশ্যই উন্নত এবং স্বাধীন অর্থনীতির সাথে সাথে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা উন্নীত করতে উপকারী উদাহরণ।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন: বর্তমানে বাংলাদেশে দেশে ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করতে পারছে। একটা সময় দেশে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট ছিল, যা ২০২০ সালে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট।
বাংলাদেশ প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরে স্থাপন করছে, যা রাশিয়া থেকে কমবেশি ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় তৈরি হচ্ছে। এখানে দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। প্রণয়ন করা হচ্ছে, ২০২৪ সালে অন্তত একটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্ভব হবে।
দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে আরও ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে বিশেষভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সমৃদ্ধির জন্য অনেকগুলি প্রকল্প চলমান রয়েছে: কর্ণফুলী টানেল (২০২৩): এটি সড়ক সংযোজনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যা বাংলাদেশের আঞ্চলিক যোগাযোগ সহজ করতে সাহায্য করছে। ঢাকা মেট্রোরেল (২০২৩): ঢাকার মেট্রো রেল প্রকল্প, যা বাস্তবায়নের ফলে ঢাকার শহরে যাতায়াতের সুবিধা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দুটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (২০২৩): এই প্রকল্পটি জনগণের জনপ্রিয়তা ভিত্তিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় আশীর্বাদস্বরূপ।
রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প: এই প্রকল্পগুলি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আঞ্চলিক উন্নতি সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী হবে। পায়রা সমুদ্রবন্দর: পায়রা সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর: এটি আঞ্চলিক বন্দর হিসেবে কাজ করবে এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে সংযুক্ত করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: এই প্রকল্পটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রয়োজনে বিদ্যুৎ শক্তি রাষ্ট্রীয় গ্রিডে যোগ করতে সাহায্য করবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল: এই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
অর্থনৈতিক উন্নতি ও চ্যালেঞ্জ:
এতশত উন্নয়নের পরেও চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির উদ্বেগ এবং পরিবেশগত সমস্যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডলার সংকট প্রশমন, মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া, ব্যাংকিং খাত ঠিক রাখা এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সরকার ক্রমশ পদক্ষেপ নিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এই উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও ।
লেখক; বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।