বিশেষ প্রতিবেদক
আন্দোলন ধংসাত্বক, না কি অহিংস হবে- এ নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। একপক্ষ চাচ্ছেন অহিংস আন্দোলন। অন্যপক্ষ চান সহিংস আন্দোলন। যার মধ্য দিয়ে সরকারকে অস্থির করে তোলা যাবে। একই সঙ্গে বিদেশিদের সামনে দেখানো যাবে সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে উগ্র আচরণ করছে। এ নিয়ে বিএনপিতে এখন তুমুল ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। যার প্রভাব পড়েছে তৃণমূল পর্যায়েও। তার ওপর আবার মাঠ পর্যায়ে অনেক মহানগর, জেলা, উপজেলাতেই বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আবার যেসব জেলা-উপজেলা বা মহানগরে কমিটি আছে সেখানেও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে বিভক্ত বিএনপি। সব মিলিয়ে আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে ডাকা মহাসমাবেশে জনসমাগম নিয়েও শঙ্কায় আছে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি বিএনপি। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেই চরম দ্বিধাবিভক্তি দেখা দিয়েছে। যার ফলে বার বার সরকার পতনের আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণার কথা বলেও দলটি কোনোভাবেই কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করতে পারছে না। আগামী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে পরবর্তি কর্মসূচী ঘোষণার কথা থাকলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ওই দিনও সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের কোনো কঠোর কর্মসূচীই দেয়া হবে না।
সূত্র জানায়, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে দলের কর্মসূচী দিচ্ছেন। যেগুলোর বেশিরভাগই জনসম্পৃক্ত এবং শান্তিপূর্ণ।
অপরদিকে লন্ডনে অবস্থানরত গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চাচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন কর্মসূচী। তিনি লন্ডন থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষনার নির্দেশনা দেন। এ নিয়ে দলের ভিতরে স্পষ্টতই দুটি ভাগ তৈরি হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি নেতারা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যেভাবে কর্মসূচী দেওয়ার কথা বলছেন, তাতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সায় নেই। তারা আর মামলা-হামলার শিকার হতে চান না। কিন্তু লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাঠ পর্যায়ে দলের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে না জেনেই কঠোর কর্মসূচীর কথা বলে যাচ্ছেন। যা এই মুহুর্তে দেয়া খুবই কঠিন।
বিএনপির ওই নেতা আরও বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চাচ্ছেন আগামী ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে যোগ দেওয়া নেতাকর্মীরা ওই দিন থেকে ঢাকার রাস্তায় বসে পড়ুক। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাক। প্রয়োজনে ধ্বংসাত্বক আন্দোলনের পক্ষে চাপ দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব কঠিন বিপাকে পড়েছেন। নেতাকর্মীদের অবস্থা বিবেচনা করে সমাবেশ শেষে সবাইকে এলাকায় ফিরে গিয়ে কর্মসূচী পালনের পক্ষে দলটির মহাসচিবসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতা। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তারা দলীয় নেতাকর্মীদেরকে কোনোরকম ঝুঁকিতে ফেলতে চাচ্ছেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা সব সময় চাচ্ছি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। ম্যাডামও চাচ্ছেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান ভিন্ন। যার ফলে দলের ভিতরে একটি অংশ চাচ্ছে সহিংস আন্দোলন। যা হবে একেবারেই আত্মঘাতী। তবে এখন পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই একমত যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা।
বিএনপি নেতৃত্ব দলীয় নেতাকর্মীদের যে ঝুঁকিতে ফেলতে চাচ্ছে না, সেজন্য গত ২৪ অক্টোবর(মঙ্গলবার) দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিও সাংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, “ঢাকায় আগামী ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে দলীয় নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবেন। মহাসমাবেশে ঘোষিত পরবর্তি কর্মসূচী সফল করার জন্য দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ২৮ অক্টোবরের পর নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করবেন।”
তারেক রহমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, আগামী ২৮ তারিখে বিএনপির মহাসমাবেশ এই সরকারের পতনের সমাবেশ। সবাইকে এই মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা লড়াই করতে পারে। দু থেকে তিন দিন না খেয়ে থাকতে পারবে। তিনি বলেন, সমাবেশের যাত্রা হচ্ছে মহাযাত্রা, এই কাফেলা মুক্তির কাফেলা। লড়াইয়ের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। লড়াই এর সময় আসবেন না, শেষ হওয়ার পরে আসবেন, তখন কিন্তু পার্টি আর আপনাকে(দলীয় নেতাকর্মী) দেখবে না। পার্টি সবার দিকেই নজর রাখছে কে লড়াইয়ে নামলো আর কে নামলো না।
তারেক রহমানের আরেক অনুসারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, পুলিশের কিছু কর্মকর্তা বাড়তি কথা বলছেন। সোজা কথা আমরা ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করবো। যেখানে (নয়াপল্টনে) বসার কথা সেখানে আমরা না বসলে নেতাকর্মীরা সারা ঢাকার অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়বে। যার যা আছে তাই নিয়ে। দেখবেন প্রত্যেক মানুষ ঘরের দরজা খুলে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে। এখন টের পাচ্ছে না, তখন টের পাবে।
বুধবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে জনতার অধিকার পার্টির (পিআরপি) উদ্যোগে ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একদফা দাবিতে’ এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।