দৈ. কি.ডেস্ক : কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের (নিকলী-বাজিতপুর) সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আফজাল হোসেন। ওই আসন থেকে টানা চারবার এমপি হন তিনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। এই ভাইয়ের হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন আফজালের। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে আফজাল হোসেনের আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না। দলের একটা বড় অংশের বিরোধিতার মধ্যেই তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
জনশ্রুতি রয়েছে, আফজাল সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ঘরের বাজার করে দিতেন। জুতাও এগিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে তিনি আবদুল হামিদের আস্থা অর্জন করেন। আর আবদুল হামিদও চেয়েছিলেন হাওর এলাকা বাজিতপুর ও নিকলী উপজেলার কর্তৃত্ব তাঁর বলয়ে থাকুক। তাই তিনি বেছে নিয়েছেন আফজালকে। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ‘ম্যানেজ’ করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন আফজাল হোসেন। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সহযোগিতায় মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তিনি।
সূত্র জানায়, আবদুল হামিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আফজাল হোসেন জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে আফজাল গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আফজালের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন তাঁর ছোট ভাই আনোয়ারা হোসেন আশরাফ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে পরের বছর পৌরসভা নির্বাচনে আফজাল হোসেন তাঁর ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। এলাকার অনেকের অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ দলের প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর, জলমহাল, বালুমহাল দখলের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। মানুষকে মামলায় হয়রানি ও মাদক কারবারের অভিযোগও রয়েছে।
পরিস্থিতি এতই ভীতিকর ছিল যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পেত না। যারা দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তারাই হামলা ও মামলার শিকার হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই ভাই মিলে বাজিতপুর উপজেলায় সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জমি দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ, বেঙ্গলা নদী দখল, নির্বাচনী এলাকার অনেক বাজারে নামকাওয়াস্তে ইজারা নির্ধারণ করে দখল, বাজিতপুরের নোয়াপাড়া গ্রামে ৭০ শতাংশ দখল করা জমিতে বাড়ি নির্মাণ, ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশে ২৯ শতাংশ জমি, সিনেমা হল রোডে একটি দোকান, বসন্তপুর মৌজায় সিনেমা হলের সামনে সরকারি জমিতে পাঁচটি দোকান, দড়িঘাগটিয়া মৌজায় সিনেমা হলের প্রায় ১৫ শতাংশ জমি, বাজিতপুর বাজারে নাপিত মহলের পুকুর, বাজিতপুর পৌরসভার দড়িঘাগটিয়া মৌজায় প্রায় দুই একর জমি দখল এবং বসন্তপুর মৌজায় প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে তিনতলা মার্কেট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দক্ষিণ পাশে প্রায় দুই একর জমি, নান্দিনা আলিয়াবাদ মৌজায় ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ২০ শতাংশ জমি, তাতলচর মৌজায় বাজিতপুর দিলালপুর রাস্তার পশ্চিম পাশে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি, গাজীরচর মৌজায় প্রায় আট একর জমি, শশেরদীঘি মৌজায় প্রায় ১০ একর ধানি জমি, বাজিতপুর মৌজায় মতুরাপুর গ্রামের পূর্ব পাশে ২০ শতাংশ জমি, দীঘিরপাড় মৌজায় মসজিদের ফেরিঘাটের পাটুলীর উত্তর পাশে ২০ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ও ঘর নির্মাণ করেছেন।
এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়ে মানহীন কাজ, বিল-হাওর নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার, বেঙ্গলা চরবাদা, কইয়া খায়রা, মাইজচর, বাহেরবালী, হুমাইপুর, ঘোড়াউত্রা নদী জলমহালের ইজারাদারের থেকে ৫০ শতাংশ হারে ভাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি দখল করে সাততলা মার্কেট (আফজালের নিজের বাসভবন), বাজিতপুরে নিজের গ্রাম দিলালপুরে তিনতলার সুরম্য অট্টালিকা এবং বাজিতপুর পৌরসভা ডাকবাংলোর সামনে দুই মৌজায় ২৭৫ শতাংশ জমি দখল করেন।
অন্যদিকে ৬/৪, সেগুনবাগিচায় হাসিনুর গ্রিন হাউসে দুটি ফ্ল্যাট, ৯৫, আগামসিহ লেনে পাঁচতলা ভবন, লালমাটিয়ায় ফায়ার ব্রিগেডের পেছনে স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট ও বংশালে সাততলাবিশিষ্ট দুটি বাড়ি। দক্ষিণ বনশ্রীতে সাততলা বাড়ি, উত্তরায় সাত কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জ ব্রিজের ঢালে ছয় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়ি, আফতাবনগরের সি ব্লকে, রাজউক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের ১৩/এ রোডে ও পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি করে প্লট, সিদ্দিকবাজারে ছয়তলার বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীতে ছেলে সাঈদ হোসেনের নামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন আফজাল হোসেন।
এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে তিনি গড়েন হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। এভাবে তিনি কত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, আফজাল ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে আফজালের নামে সিঙ্গাপুরের অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি-গাড়ি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি-গাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে।
দুদক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ইকবাল হোসাইন বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলা দুদক কার্যালয়ে আফজাল হোসেনের ব্যাপারে কোনো ফাইল ওপেন হয়নি। এই বিষয়ে হেড অফিস বলতে পারবে। আর তাঁর ভাই আশরাফের দুটি ফাইল ছিল। একটা হলো তাঁর সম্পদের, আরেকটা ছিল অর্থ আত্মসাতের। আশরাফের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটিতে এখনো তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি।