সম্পাদকীয়:
রাজধানীর একটি হোটেলে গত মঙ্গলবার মানবাধিকার সুরক্ষায় গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকাবিষয়ক মতবিনিময় সভায় বলা হয়, গত বত্সর জুলাই হইতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২৮২টি অভিযোগ পাইয়াছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই সকল অভিযোগের মধ্যে ১৫২টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় নাই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলিয়াছেন যে, পুলিশও অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ করে’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট আমরা আরো একটি প্রশ্ন রাখিতে চাই, কোথাও যদি কোনো নির্বাচনি প্রার্থীকে অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্য তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দেওয়া হয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করা হয়—তখন কি তাহা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে না? ইহা ঠিক যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো আমরাও মনে করি, সকল পুলিশ এই কাজ করেন না, কেউ কেউ করেন। তবে আমাদের জিজ্ঞাসা আরো একটু প্রসারিত। কোনো কোনো প্রার্থী আছেন যাহারা মগজে-মননে স্বাধীনতাবিরোধী এবং রাজাকারের বংশধর, অথচ তাহারা ক্ষমতাসীনদের শামিয়ানায় ভেক ধরিয়া অনুপ্রবেশ করিয়াছেন। তাহারা আওয়ামী লীগের চাইতেও অধিক আওয়ামী লীগার, তাহারা বঙ্গবন্ধুর নাম বলিতে বলিতে মুখে ফেনা তুলিয়া ফেলিবার নিখুঁত নাটক করেন অথচ ভিতরে ভিতরে তাহারাই সবচাইতে বড় বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী। সুযোগ পাইলেই, অর্থাত্ ক্ষমতার পালাবদল হইলেই তাহারা ডিগবাজি দিবেন। এমনকি ক্ষমতার পালাবদলের জন্য তাহারাই ভিতরে ভিতরে ভাইরাস হিসাবে কাজ করিতেছেন। ইহার পাশাপাশি অবৈধভাবে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হইতেছেন। বাংলায় যাহাকে বলে ‘আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ’ হওয়া, তাহার সবচাইতে ভালো উদাহরণ হইল মাদক ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীরা ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় মাদকের কারবার করিয়াছেন এবং করিতেছেন। এই সংক্রান্ত খবর ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হইয়াছে যে, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের অফিসে বঙ্গবন্ধুর ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙাইয়া তাহারা এক ধরনের ঢাল তৈরি করেন। আবার অন্য কোথাও কোনো সংগঠনের অফিসে হামলা করিয়া সেই অফিসের দেওয়ালে টাঙানো বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙিতেও তাহারা দ্বিধা করেন না। কারণ তাহাদের হূদয়ে তো বঙ্গবন্ধু নাই, বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ রহিয়াছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধু কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙিতে তাহাদের হাত কাঁপিবে কেন? ইহা তাহাদের দারুণ চাতুর্যময় কৌশল। কারণ, ইহাতে তাহারা এক ঢিলে দুই পাখি মারিতে পারেন। ছবি ভাঙিয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষও দেখানো হয়, আবার সেই ভাঙা ছবির ছবি তুলিয়া তাহারা উলটা সেই অফিসের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের তরুণ কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাও দেন। দুঃখজনকভাবে কোথাও কোথাও প্রশাসনও এমন একটি পর্যায়ে চলিয়া গিয়াছে, পয়সা খাইয়া তাহারাও বলিয়াছেন যে, ‘হ্যাঁ প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙা হইয়াছে।’
বিজ্ঞান অনুযায়ী, কোনো ঘটনার সত্যতা খুঁজিতে কেস স্টাডি করিতে হয়। সুতরাং কেস স্টাডি করিয়া সরেজমিনে গিয়া দেখিতে হয়—আসল রহস্য কী? তাহার পর যাহারা দোষ করিয়াছে, তাহাদের অপরাধ অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়াটাই দস্তুর। সমগ্র দেশের মানুষ সকল এলাকার সকল কাহিনি জানেন না, সকল সত্য বুঝিতেও পারেন না; কিন্তু যাহারা স্থানীয় লোক, তাহারা অন্তত বুঝিতে পারিবেন—কোনটা সত্য আর কোনটা বানোয়াট। আমরা বারংবার এই ব্যাপারে সতর্ক করিয়াছি; কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হইল—কাঁচা টাকার যূপকাষ্ঠে অনেকেই তাহাদের প্রশাসনিক দায়িত্ব ও বিবেককে বিসর্জন দিয়াছেন। এমনকি ইতিপূর্বে পুলিশেরই অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশও এই ব্যবসায়ের টাকার লোভ সামলাইতে পারেন নাই।
একটি নিয়মতান্ত্রিক দলের তরুণদের বিরুদ্ধে যখন হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়, তখন সেই মামলার অভিঘাত সেই তরুণদের জীবন ও মনোবলকে তছনছ করিয়া দিতে পারে। তাহা নির্বাচনের পরিবেশকেও আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া তোলে এবং নষ্ট করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। এই ঘটনাগুলি ইতিপূর্বে ঘটিয়াছে। সুতরাং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট আমাদের প্রশ্ন থাকে, এইগুলি কি মানবাধিকার লঙ্ঘন নহে?