ড. দেবাশিস চন্দ্র আচার্য্য
বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব সরকার। ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর কৃষি ও কৃষকের কথা চিন্তা করে ১৭ জানুয়ারী ২০১০ সালে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরকারি ভর্তুকি পেতে কৃষকদের ১০ টাকা প্রারম্ভিক জমা দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলার অনুমতি দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করে। সেক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয় যে, কৃষকদের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ব্যালেন্স রাখার শর্তটি অবশ্যই বাতিল করতে হবে এবং তাদের পরিষেবার জন্যও কোনো ধরনের ফিও নেওয়া হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা যায় এবং কৃষকদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি যোগযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কৃষকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষিঋণ প্রপ্তির ফলে কৃষিতে ব্যাপক বিপ্লব সাধিত হয়। তার ফলে গ্রামীণ ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনের নিকট হতে উচ্চহারে দাদনের হাত থেকে মুক্তি পায়।
যে কোনো কৃষক জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ বা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত কার্ড দেখিয়ে এ জাতীয় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। কৃষক সম্প্রদায় যাতে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি সহজে পেতে পারে সেজন্য সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বর্তমানে সরকার সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেলে বিশেষ ভর্তুকি দিচ্ছে। যাতে কৃষকরা স্বল্প খরচে তাদের কৃষি পন্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে এবং এর মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সরকার কৃষি সরঞ্জামে ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল স্বল্প খরচে জনগনের দোরগাড়ায় পৌছে দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকার কৃষককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২৮২ কোটি টাকা। দেশের মানুষ শতভাগ বিদ্যুতের আওয়ায় আসায় সেচ ব্যবস্থা নিয়মিত হয়েছে। সেচ মৌসুমে প্রান্তিক অঞ্চলে বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে কৃষিকাজে নিয়োজিত জনসংখ্যার মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্যতা, কৃষি কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারনে বিভিন্ন ফসলের ফলন হ্রাসের ফলে কৃষিতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে যেকোনো সংকট মোকাবেলার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে ও যেকোনো সম্ভাব্য খাদ্য সংকট এড়াতে নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং “তাই এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা উচিত নয়” প্রধানমন্ত্রীর এই শ্লোগানকে সামনে রেখে কৃষিখাতকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকদেরকে সরাসরি সার, বীজ, কীটনাশক ও সর্বোপরি জ্বালানীতে সরাসরি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে আমাদের সোনার বাংলাদেশ যাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সেজন্য কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিরসনকল্পে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। যাহাতে খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান হতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারে। ‘এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না’
বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল উন্নতি সাধিত হয়েছে। যা কৃষি এবং ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। পন্য পরিবহন অধিকতর সহজ লভ্য হয়েছে। ফলে কৃ্ষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন ও কৃষিকাজে আগ্রহী হচ্ছেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সারাদেশে কৃষি জমি চাষে ৯০%, আগাছা দমনে ৬৫%, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০%, সেচকার্যে ৯৫% এবং ফসল মাড়াইয়ের কাজে ৭০% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো কৃষি গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। এর ফলে প্রতিটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মাধ্যমে নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে প্রাথমিক কৃষি পণ্য (শুধুমাত্র ফসল) উৎপাদনে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে। দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কৃষি তথা ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়েছে । মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র, কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রান্তিক কৃষকসমাজ সহজেই কৃষিখাতের আধুনিকায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর মধ্যেও কৃষকের পাশে ছিল শেখ হাসিনার সরকার। করোনায় শ্রমিক সংকটে থাকা কৃষকদের জমির পাকা ধান যাতে ঘরে তুলতে সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকদের ধান কাটতে সহায়তা দেন। কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পেরেছিলেন কৃষক। করোনার সময়ে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।
একইসাথে দেশের বেকার যুব সমাজকে কৃষিতে উৎসাহিত করতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ন্যূনতম ৮ম শ্রেণি পাশ যেকোন যুবক এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পেরেছেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে মাসিক চার হাজার পাঁচশত টাকা প্রশিক্ষণ ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পাঁচ বছরের উদ্যোগ (আমদানি নির্ভরতা কমাতে) গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করতে পারলে আমরা আরও অনেক ফসলের মাথাপিছু ব্যবহারের ক্ষেত্রে শীর্ষ দশে প্রবেশ করতে পারব। আমাদের কৃষির এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর জন্য আমাদের সকলকেই নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে যাহাতে পুনরায় বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে এবং কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে পূর্বের ন্যায় ভবিষ্যতেও কাজ করে যেতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে কৃষকদেরকেও স্মার্ট কৃষক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী, সম্বৃদ্ধি ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানে আমাদের আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্নতা অর্জনের দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে এবং বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষি নীতিসমূহ যথাযথ অনুসরনের মাধ্যমে খোরপোশ কৃষিকে বানিজ্যিক কৃষিতে রুপান্তর করতে হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি