নিজস্ব প্রতিবেদক
‘সংসার চালাতে না পেরে যৌনকর্মের পথ বেছে নিচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা’ – ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে এমন প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে মনগড়া প্রতিবেদনে প্রত্যাহার এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন তারা।
পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করায় মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) রাজধানীতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাতটি শ্রমিক ফেডারেশন। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিককে নিয়ে সম্প্রতি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ‘ উইম্যান মেকিং ক্রিস্টমাস জাম্পারস ফর ইউকে টার্নস টু সেক্স ওয়ার্ক টু পে বিল’ -কে ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও মনগড়া গল্প বলে জানিয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা। একইভাবে এমন ভিত্তিহীন সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এ ধরণের ভিত্তিহীন মনগড়া রিপোর্ট যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন বিজিএমইএ নেতারা।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ছদ্মনাম ব্যবহার করে এক গার্মেন্টস কর্মীর কথা তুলে ধরে বলা হয়, ওই পোশাক শ্রমিক দিনের বেলা কারখানায় কাজ করে রাতে যৌন কর্মী হিসেবে কাজ করেন। যেখান থেকে তিনি গড়ে ৬০০ টাকা পান। অভাবের তাড়নায় তিনি দিনে পোশাক শ্রমিক আর রাতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। শ্রমিক নেতাদের মতে, এই গল্প কাল্পনিক এবং একেবারে মিথ্যা।
মঙ্গলবার আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে শ্রমিক নেতা লাভলী ইয়াসমিন বলেন, `সম্প্রতি ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ানে বাংলাদেশি এক নারী পোশাক শ্রমিকের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রাতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন নারী পোশাক শ্রমিকরা। উক্ত প্রতিবেদনে এক নারী শ্রমিকের জীবনকাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট যা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ধংসের লক্ষ্যে অপপ্রচার। আমরা উক্ত ভিত্তিহীন, বানোয়াট প্রতিবেনকারী সংবাদমাধ্যমেকে রাষ্ট্রীয় বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
মুক্ত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা রানী খাঁন বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে মোট শ্রমিক রয়েছেন প্রায় ৩৬ লাখ, যার মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী শ্রমিক। এই সেক্টরের শ্রমিকরা রাত দিন কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদিত পন্যের মান বৃদ্ধি করে দক্ষতা ও অধিক উৎপাদনশীলতা বজায় রেখে দেশ ও শিল্পের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অথচ সেই নারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কিছু অসাধু সংবাদ মাধ্যম, সাংবাদিকগণ প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করে দেশে ও দেশের পোশাক শিল্পকে ধংস করা লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যচার করে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘বর্তমান সরকারের শ্রমবান্ধব প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের ৮ নভেম্বর শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারন করেন যা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। মজুরি বাস্তবায়নের এই সময়েই গার্মেন্টস শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের নিয়ে বানোয়াট ও অপমানজনক সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। আমরা উক্ত সংবাদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে উক্ত প্রত্যাখান করছি।’
সম্মিলিত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা নাহিদুল হাসান নয়ন বলেন, ‘কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের দেশের পোশাক খাত এবং নারী শ্রমিকদের নামে গুজব ছড়িয়ে বিশ্বের দরবারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যে শ্রমিকদের শ্রমের ঘামে ঘোরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা, যে নারী শ্রমিকদের বলা হয় গোল্ডেন গার্ল সেই নারী শ্রমিকদের হেয় প্রতিপন্ন করে যৌনকর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী-নীতি, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা ও আইএলও কনভেনশন-১৯০ লংঘন করেছে। অনতি বিলম্বে তারা বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের কাছে এবং রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি না করলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো জরিপ এবং তথ্য উপাত্ত ছাড়াই এমন নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করার কারনে যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে মানহানির মামলা করার অনুরোধ করছি।’
গণমাধ্যমে এমন প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিজেএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান জানান, এরকম একটা সংবাদ আমাদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। এটি ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বাস্তবতা বিবর্জিত ও মনগড়া ।
তিনি বলেন, ‘এই নিউজের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। এ ধরণের নিউজ করে এই সেক্টরে যেসব মেয়েরা কাজ করছে তাদেরকে আসলে নিচু করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের নারীদের অসমান করা হয়েছে।’
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ‘সংবাদে যে বিষয়বস্তু ও স্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে তার পুরোটাই বানোয়াট। কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গির চরে তো আমাদের এরকম কোনো কারখানা নেই। ফরমাল সেক্টর আছে ৪৩টা। এর বাইরে ইনফরমাল সেক্টর আছে আরও হাজার হাজার। তাহলে তারা তো কাজ করে খাচ্ছে বাংলাদেশে। তাহলে কি বাংলাদেশ পুরোটাই এভাবে চলতেছে।’ যারা এই রিপোর্টটা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দাবি জানান তিনি।