ড. মো. মনিরুল ইসলাম (সোহাগ)
জঙ্গিবাদ পৃথিবীব্যাপী পরিচিত এবং বহুল আলোচিত। জঙ্গি তৎপরতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ এবং মানবতার প্রতি চরম হুমকি। রাজনৈতিক কারণে বা অন্য কোন স্বার্থসিদ্ধি ব্যাপারে হোক, যা সভ্য সমাজে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই জঙ্গি তৎপরতা আগে নির্দিষ্ট কতিপয় দেশে বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। ইদানিং পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গিবাদের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মকে ব্যবহার করা হয় স্বার্থ হাসিলের জন্য। ধর্ম এখানে মূল অবলম্বন নয়, আনুষঙ্গিক মাত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে, যার নেতৃত্ব দেন জিয়াউর রহমান। তিনি ক্ষমতা দখল করেই সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ বাতিল করে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। যার কারণেই ধর্মীয় জঙ্গিবাদের যাত্রা শুরু হয় এই দেশে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এই দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে শুরু করে। আর ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পর জঙ্গিবাদের বিস্তার লাভ করে। “আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান”- এ স্লোগানের গানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে ১৯৯২ সালে। ঠিক তখনই জামায়াতের সহযোগিতায় জঙ্গি সংগঠন “হরকাতুল জিহাদ” আত্মপ্রকাশ করে এবং জামায়াত জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে। আর এদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় বিএনপি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ সালের জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেছিল এই দেশের সাধারন জনগণ। সেই অনিশ্চয়তার দিনগুলোর কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছে। আর তরুণ প্রজন্মের তো মনে থাকারই কথা নয়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে বোমা হামলা, ২০০১ সালের ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সভায় বোমা হামলা, ২০০১ সালে জামালপুর ধর্মান্তরিত দুইজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে জবাই, ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় বোমা হামলা ও ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে বোমা হামলা, ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের দানিয়ায় বোমা হামলা, ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের হযরত শাহজালালের দরগা শরিফে বোমা হামলা, ২১ মে তখনকার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে চালানো বোমা হামলা এবং শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বোমা হামলা, একই মাসে হবিগঞ্জের বৈধর বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলা। তবে জঙ্গিবাদের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের মুন্সীগঞ্জ ছাড়া বাকি ৬৩ জেলায় একযোগে প্রায় পাঁচশত পয়েন্টে বোমা হামলার মাধ্যমে। এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়, এটা ছিল সুপরিকল্পিত এবং তাদের শক্তি-সামর্থ্য জানানোর কৌশল। এছাড়াও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত, ভিন্ন মতাবলম্বীদের গাছের সাথে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে নির্যাতন, হত্যা, টার্গেট কিলিং ও পঙ্গুত্বসহ বাংলা ভাইয়ের রাম-রাজত্ব কারোও অজানা নয়। তাদের এহেন ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সেসময়কার বিএনপি-জামায়াত সরকার প্রকাশ্যে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও মন্ত্রী-এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল অসহায়। অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিদের পাহারাদার হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে তাদের। তারেক রহমানের সাথে জঙ্গিদের এতই গভীর সম্পর্ক ছিল যে, বাংলা ভাই জনসম্মুখে তারেক জিয়াকে মামা সম্বোধন করে ফোন করতো। এমনকি, তারেক রহমান ২০০৪ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলো, ‘শিবির-ছাত্রদল এক মায়ের পেটের দুই সন্তান’। কথাটা শুধু ছাত্র সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা বিএনপি ও জামায়াতের ক্ষেত্রেও অদ্যাবধি প্রযোজ্য।
কিন্তু সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা দেখি উল্টো চিত্র । তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রণয়ন করেন সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এবং অন্তর্ভুক্তি করেন আইনের প্রাসঙ্গিক সংশোধনী । গঠন করেন ১৭ সদস্যের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কমিটি। এলিট ফোর্স র্যাব, বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটসহ পুলিশের সব ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও কার্যক্রম জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন। দেশকে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু কন্যা ঘোষনা দেন “জিরো টলারেন্সের”। এটা যে কোন মুখের কথা ছিলো না, তা এদেশের সাধারন মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছে। পরবর্তীতে তার নির্দেশে গঠন করা হয় পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার-টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টারসেপশন ইউনিট, যা জঙ্গিবাদ দমনে সরাসরি কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা ঠেকাতেও সতর্ক রয়েছে এসব বাহিনী। এমনকি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠন, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক-ছাত্র সমাজ, অভিভাবকবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-যার নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে ধ্বংস হয় তাদের আস্তানা। অভিযানের মুখে তাদের অনেকেই আত্মহত্যা করে এবং শতাধিক জঙ্গি নিহত হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক প্রায় ২ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯ হাজারেরও বেশি জঙ্গি। এ পর্যন্ত জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল-হিকমা, জেএমজেবি, হিযবুত তাহরীর, হুজিবি, এবিটি, আনসার আল ইসলাম ও আল্লাহর দল নামে ৮টি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করেছে বর্তমান সরকার। বিভিন্ন মামলায় বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আসাদুজ্জামান পনিরসহ অনেকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অভিযানে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের কারাগারের ভেতরে জঙ্গিবাদী ভাবাদর্শ থেকে সরিয়ে আনা বা ডি-রেডিক্যালাইজেশন মাধ্যমে তাদের বোঝানো হয়, তারা ভুল করছে বা ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে এইভাবে তাদের কাউন্সিলিং করা হয়। তাছাড়া স্কুল-কলেজে লিফলেট-ফেস্টুন বিতরণ, বেতার, টেলিভিশন, পত্রিকায় ফিলার-অ্যাড এবং সচেতনতামূলক প্রচার ইত্যাদি কার্যক্রমও উল্লেখযোগ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও কাউন্সিলিংয়ের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক জঙ্গি সরকারের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শেখ হাসিনার এইসব সমন্বিত উদ্যোগের ফলে বিশ্বে জঙ্গিবাদ দমনে অনন্য নজির গড়েছে বাংলাদেশ। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর দীর্ঘ সাত বছরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া দেশে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলা ঘটেনি। জঙ্গিবাদ পুরাপুরি নির্মূল না হলেও জঙ্গি সংগঠনগুলোর মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের দাবি, দেশের জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সম্প্রতি প্রকাশিত, ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স এন্ড পিস-২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়েও বাংলাদেশ অনেকটাই ভালো অবস্থানে রয়েছে। সূচক অনুযায়ী, আফগানিস্তান হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের এক নম্বর দেশ। পাকিস্তানের অবস্থান ৬, ভারতের অবস্থান ১৩, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৩০, যুক্তরাজ্যের অবস্থান ৪২ আর বাংলাদেশের অবস্থান ৪৩। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২২তম, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪০তম আর বর্তমানে ৪৩তম। অর্থাৎ ২০১৬ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে সন্ত্রাসবাদ আরও কমেছে, দেশ নিরাপদ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক ইনডেক্সে হাই-রিস্কের (উচ্চ-ঝুঁকি) দেশ থেকে লো-রিস্কের (নিম্ন-ঝুঁকি) দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি জার্মানির হেসে প্রদেশের সংসদ সদস্যরা পার্লামেন্টে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এমনকি বিশ্ব সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা আয়োজিত সভায় বক্তারা বলেন, সন্ত্রাসদমনে শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে বিশ্ব শান্তি রক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত ও রোল মডেল হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি দেশকে বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ। বর্তমানে বিভিন্ন সময় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদে জর্জরিত দেশকে বাংলাদেশের মতো নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে।
শুধুমাত্র রাষ্ট্রের নীতি, অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাস এবং শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ, দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সত্যিকার অর্থেই, জঙ্গিবাদ দমনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই গৃহীত কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ জঙ্গিমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। অর্থনীতির এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তে হবে। আর এটি সম্ভব হবে, একমাত্র শেখ হাসিনার মতো দূরদর্শী নেতা দ্বারা দেশ পরিচালিত হলে।
লেখক:প্রক্টর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।