প্রফেসর ড. ওমর ফারুক মিয়াজী
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় এবং স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করে। দলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে।
জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা আধাসামরিক বাহিনী শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করে। দলটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী, বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যায় সহযোগিতা করেছিল। এই দলের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোড়পূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে। পরে এসব অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকর্মীকে মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নতুন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং দলের নেতারা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান।
পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এর স্ব-পরিবারকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৭ সালে জামায়াতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামি দল বিএনপির সাথে মিলিত হয়ে আরো অন্য দুটি দলসহ চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট জয়লাভ করলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে জামায়াতের দুজন সদস্য মন্ত্রী নির্বাচিত হন।
২০০৮ সাল থেকে দলটির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি ৩০০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি আসন লাভ করে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে; ২০১২ সালের মধ্যে দুজন বিএনপি নেতা ও জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান সদস্যসহ ৮ জন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের করা হয়।
২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক সদস্যসহ মোট চার জনকে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। রায়গুলোর প্রতিবাদে জামায়াত দলটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার মাধ্যমে অনেক লোক নিহত করাসহ সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত করে।
বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবিরা জামায়াত-ই-ইসলামীর রাজনীতিতে বেশ কিছু মারাত্নক ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। যা- (১) তারা রাজনীতিকে জিহাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে; (২) তারা ধর্ম প্রতিষ্ঠা ধারণার অর্থকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হ্রাস করে মারাত্মক ভুল করেছে; (৩) দলটি তার আদর্শের সাথে আপোস করেছে এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে আরও মনোনিবেশ করেছে; (৪) মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত এমন এক দলের সমর্থন করেছিল এবং তার পক্ষে অস্ত্র নিয়েছিল যাকে আগে এরা “অমুসলিম “তাগুতি” (অত্যাচারী) সরকার” বলে অভিহিত করেছিল।” এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি।
জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের হাই কোর্ট একটি রুল জারি করে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলে আদালতের বেঞ্চ।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। পরবর্তীতে ১লা আগস্ট ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রুলের রায় ঘোষণা করে এতে সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং সংগঠনটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। জামায়াত-ইসলামী উক্ত রায়ের বিপরীতে আপিল করেছিলো। উক্ত আপিল গত ১৯ নভেম্বর ২০২৩ বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্বের রায় বহাল রাখেন। যাহার মাধ্যমে জামায়াত-ইসলাম এর রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন বাতিল এবং নির্বাচনের জন্য অনুপোযুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়।
গত ২০ নভেম্বর সোমবার দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসের জরুরি অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় যে, তাঁরা সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে জোরদার পদক্ষেপ গ্রহন করবে। যাহা বিএনপির আন্দোলনের সাথে মিলে যায়।
জামায়াতে ইসলামী এর আগে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্যে সমাবেশ করে। এরপর তারা শুধু ঝটিকা মিছিলে সীমাবদ্ধ ছিল। ১০ জুন ২০২৩ শনিবার দীর্ঘ এক দশক অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঢাকায় দলটি প্রকাশ্যে সমাবেশ করে এবং গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিএনপির সাথে একত্রিত হয়ে বর্তমান সরকারকে হটানোর উদ্দেশ্যে একদফা আন্দোলনে নেমে দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়।
তাহাদের দেশ বিরোধী আন্দোলনের কিছু উদাহরন হলো পুলিশ হত্যা, দেশের সম্পদ জ্বালানো পোরানো, এবং দেশের মানুষের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে বাধা প্রদান করা। বর্তমানে তারা বিএনপির সাথে একত্রিত হয়ে হরতাল-অবরোধ ডেকে এর পক্ষে জনসমর্থন না পেয়ে চোরা গুপ্ত হামলার মাধ্যমে যানবাহনে আগুন লাগানো, দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজে বাধা প্রদান করে মানুষের মধ্যে আতংক তৈরী করার চেস্টা করছে। যাহা দেশ বিরোধী, মানবতা বিরোধী ও ধর্ম বিরোধী কাজের সামিল।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইহা বলা যায় যে, জামায়াত-ইসলামী বাংলাদেশ দল একটি স্বাধীনতা বিরোধী, দেশ বিরোধী, ধর্ম বিরোধী ও ক্ষমতা লোভী একটি রাজনৈতিক দল ছিলো।
পূর্বের ইতিহাস হতে দেখা যায় যে, বিএনপির হাত ধরেই জামায়াত আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় এবং বিএনপি জামায়াত একই ধারায় ও একই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জনগনকে ঠকানোর ও সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করে হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে নোংরা মানসকিতার রাজনীতি করে আসছে।
তাই বাংলাদেশের জনগনকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে যে, জামায়াত ইসলাম পরবর্তীতে আর কখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন নামেই কোন ভাবেই যেন প্রবেশ করতে না পারে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে একযোগে প্রতিহিত করতে হবে।
লেখক: জেনেটিক্স এন্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।