আ.স.ম. ফিরোজ-উল-হাসান
১৯৪১ সালে আবুল আ’লা মওদুদী কর্তৃক জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই দলটি মূলত পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হলেও, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও তাদের একটি শাখা গঠিত হয়। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলাম’র দেশবিরোধী ভূমিকা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের কারণে, দলটি বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে।
২০১৩ সালে, বাংলাদেশের উচ্চ আদালত জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এই রায় অনুযায়ী, জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধের বিরোধী এবং তাদের কার্যক্রম দেশের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার চেতনার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে, জামায়াতে ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত।
সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলাম’র নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া একাত্তরে দেশবিরোধী ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয় বলে মত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ‘সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলাম একটি ক্রিমিনাল দল হিসবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়।’
মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলাম’র ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলাম’র ভূমিকা অত্যন্ত বিতর্কিত ও সমালোচিত। ১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রাম করছিল, তখন জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে, একইভাবে জামায়াতে ইসলাম একাত্তরে এদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি সশস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছে। জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের একজন ছিল।
তার নেতৃত্বে জামায়াত-ই-ইসলামী রাজাকার বাহিনী এবং জামায়াতের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানি ইসলামী জামায়াতে তালাবা বা ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) সদস্যদের নিয়ে এর অধীনস্থ বিশেষ ঘাতক সংস্থা আল-বদর গঠন করে এবং গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে।
সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতি মনোভাব: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জামায়াতে ইসলাম’র সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি মনোভাব বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। তাদের নীতি ও বক্তব্য সবসময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি বৈষম্যমূলক। বিভিন্ন সময়ে জামায়াতে ইসলাম’র নেতারা হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন যা সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও বৈষম্যে তৈরি করেছে।
তাদের নীতি ও প্রস্তাবনা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এই দলের কিছু সদস্য এবং অনুগামীরা সাম্প্রদায়িক সংঘাত উসকে দেয়ার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছেন, যা বাংলাদেশের সামাজিক সহাবস্থান ও সংহতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জামায়াতে ইসলাম’র নীতি ও বক্তব্যসমূহ মৌলিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, যা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি অবমাননাকর। এই ধরনের মনোভাব ও কার্যক্রম সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যা দেশের সামাজিক ঐক্য ও উন্নয়নের প্রতি বাধা সৃষ্টি করে এবং সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
নারীদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব: কৃষিক্ষেত্র ও গৃহস্থালি থেকে শুরু করে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অবদান রয়েছে। নারীর অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দেশের উন্নয়নের মূলধারায় নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
অথচ, নারীর অধিকার এবং নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিকভাবেই জামায়াতে ইসলামর নারীদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
যেখানে পুরো বিশ্ব নারী-পুরুষের রাজনীতি সহ সমাজের নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে তারা কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীদেরকে অবদমন করে পুরুষতান্ত্রিক শাসন কায়েম করতে চায়। অথচ, ক্ষমতার লোভে তারা বিভিন্ন সময়ে নারী নেতৃত্বের রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যা তাদের হীন উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেয়।
জামায়াতে ইসলাম এবং এর ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সহিংস কার্যক্রম: জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের ছাত্র শাখা, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বিভিন্ন সময়ে সহিংস কার্যক্রম এবং অপরাধজনিত ঘটনাবলীতে জড়িত থাকার অভিযোগে বিতর্কিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে অনেকবার সহিংসতায় জড়িয়েছে।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার মতো সহিংস কার্যক্রমে জামায়াতে ইসলাম এবং ছাত্রশিবির প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে, জামায়াতে ইসলাম এবং ছাত্রশিবির বিভিন্ন রাজনৈতিক অশান্তি, সংঘর্ষ, এবং সহিংসতায় জড়িত হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির নানা ধরনের অপরাধমূলক ও সহিংস কর্মকাণ্ড করে। এই ধরনের কার্যক্রম জামায়াতে ইসলাম এবং ছাত্রশিবিরের সম্পর্কে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রতি এই ধরনের কার্যক্রমের প্রভাব গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী।
জামায়াতে ইসলাম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি: বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এই দলটির উগ্রপন্থী মতাদর্শ এবং সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক সমালোচনা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এবং সহিংসতার ইতিহাস বিশ্বজুড়ে বিতর্ক ও চিন্তার সৃষ্টি করেছে। যার ফলে তাদের উপর বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি নিষেধাজ্ঞা বা বিধিনিষেধও আরোপ করেছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে এই দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য কিছু দেশ জামায়াতে ইসলামর সদস্যদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছে।
এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ প্রমাণ করে যে, জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ এবং চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞাসমূহ তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং আইনগত মানদণ্ডের প্রতি প্রশ্ন তুলেছে এবং বিশ্বজুড়ে তাদের উপর নজরদারি বাড়িয়েছে।
জামায়াতে ইসলাম নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং দণ্ড: বাংলাদেশে, জামায়াতে ইসলামর বেশ কিছু শীর্ষ নেতাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (International Crimes Tribunal, ICT) এর মাধ্যমে বিচার করা হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালে, জামাতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা, যেমন গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, এবং গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পেয়েছেন।
এই বিচারের প্রক্রিয়া ও ফলাফল বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে, বাংলাদেশের মানুষ এই বিচারকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার হিসেবে দেখেছেন।
বাংলাদেশের জনগণের জামায়াতে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা: বাংলাদেশের মানুষ দলটিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ, সহিংস কার্যক্রম, এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য নেতিবাচকভাবে দেখে। জামায়াতে ইসলাম’র কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের সহিংস এবং বিভেদমূলক কার্যক্রম দেশের সামাজিক শান্তি এবং সহনশীলতাকে ব্যাহত করেছে।
সম্প্রতি, জামায়াতে ইসলাম’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম এবং সহিংস প্রতিবাদের ঘটনাবলী বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ বিশেষত যুব সমাজ, জামায়াতে ইসলাম’র এই ধরনের কার্যক্রমকে দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতির প্রতি বাধা হিসেবে দেখে।
তারা মনে করেন এই দলের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রপন্থী মতাদর্শ বাংলাদেশের সামাজিক শান্তি এবং অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে এবং দেশের সেক্যুলার চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
জামায়াতে ইসলাম’র ঐতিহাসিক কার্যক্রম এবং সহিংস মতাদর্শের কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তারা ব্যাপকভাবে অপ্রিয় এবং অস্বীকৃত। বাংলাদেশের জনগণের মনে করে, জামায়াতে ইসলাম’র মতাদর্শ এবং কার্যক্রম দেশের সেক্যুলার এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধী। এই কারণে, তাদের রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বা সমাজে আস্থা বা বিশ্বাস অর্জন অসম্ভব। তবে গণতন্ত্রের পক্ষে অনেকের সমর্থন জুটলেও জামায়াতের মতো চিন্তাধারাও রয়েছে। এদের সঙ্গে সমঝোতা অসম্ভব বলেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য।
এদের লালন পালন করা মানে দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা। শেষ পর্যন্ত এই সন্ত্রাসের থাবা থেকে কেউই মুক্ত নয়। ১৯৭১ এ-ও যেমন কারও প্রাণ নিরাপদ ছিল না। অথচ এ বিষয়ে বিশ্ব ঐকমত্যের এমন অনুকূল পরিবেশে রাজনীতিকরা দৃশ্যত দোদুল্যমান! আগামী নির্বাচনের ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তারা।
তাই আদালত বা নেতাদের দিকে তাকিয়ে না থেকে সবল ভূমিকা দিয়ে বরং ফ্যাসিবাদ-বিরোধীরা দৃষ্টি কাড়ুক, নয়তো অপেক্ষা করতে হতে পারে বাতাসে লাশের গন্ধের।
লেখক: প্রক্টর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।