ড. মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান
১৯৪৭ এ ভারত বিভক্তির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ থেকে পুর্ব বাংলার জনগণকে মুক্তি দিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ব্ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) স্বাধীনতার ডাক দেন এবং ২৬ মার্চ বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। জামায়াত-ই-ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে নিরীহ বাঙালীদের গণহত্যায় অংশ নেয়।
যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত-ই-ইসলামীর ভূমিকা:
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৮১ সালে দেয়া এক পরিসংখ্যানে সম্মিলিত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে স্বল্পতম সময়ে বৃহত্তম সংখ্যায় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে।
তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসররদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রওনক জাহান সেঞ্চুরি অফ জেনোসাইড বইয়ের জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ গবেষণা প্রবন্ধে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা ৩০ লক্ষ, আড়াই লক্ষ ধর্ষণ, বাংলাদেশ থেকে ভারতে ১ কোটি শরণার্থীর সীমান্ত ত্যাগ ও ৩ কোটি লোকের স্থানাপসরণ ও অন্যান্য স্থান পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জামাত-ই-ইসলামী অন্যান্য প্রো-পাকিস্তানি ইসলামিক দলগুলোর সাথে একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিরোধিতা করে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান কুটনীতিক জনাব পিটার টমসেনের মতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা জামায়াত-ই-ইসলামীর সাথে একত্রিত হয়ে আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী গড়ে তোলে যারা নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের উপর গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়। এদেরই দোসর রাজাকার বাহিনীও তাদের সাথে মিলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় যুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাস।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াত-ই-ইসলামীর উত্থান-পতন:
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে জামায়াত-ই-ইসলামীসহ ধর্মর্ভিত্তিক রাজনীতি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিষিদ্ধ করেন এবং জামায়াত-ই-ইসলামীর নেতা গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বাতিল করেন। তখন জামায়াত-ই-ইসলামীর বেশ কিছু নেতা বিদেশে পালিয়ে যায়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কিছু সেনা সদস্যের হাতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। একই বছরে, শেখ মুজিবের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এমন আরও চারজন বিশিষ্ট জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের একটি অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে ধারাবাহিক আরও কতগুলো অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়।
এই সমস্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়, যখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জামায়াত-ই-ইসলামীর জন্য রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করেন। পঞ্চম সংশোধনী ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বিধান বাতিল করে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের বিধান দেয়। জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত-ই-ইসলামীকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তার মৃত্যুর পরও বেগম খালেদা জিয়া এই উত্তরাধিকার অব্যাহত রাখেন। জিয়াউর রহমান সরকার গোলাম আজমকে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয় এবং খালেদা জিয়া সরকার ১৯৯৪ সালে তার নাগরিকত্ব বহা্ল করে।
সামরিক সরকার জেনারেল এরশাদও জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করেন এবং তার শাসনামলে জামায়াত-ই-ইসলামীকে সমর্থন অব্যাহত রাখেন।
জমায়াত-ই-ইসলামী তার হারানো ক্ষমতা ও গৌরব পুনরুদ্ধার করতে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপিকে কাজে লাগায়। এর মাধ্যমে দলটি বাংলাদেশের অত্যাবশ্যক অর্থনৈতিক খাতগুলিতে প্রবেশাধিকার এবং নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এগুলোর মধ্যে সু-অর্থায়িত এনজিও সেক্টর এবং ইসলামী ব্যাংক অন্যতম। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এই ধারণাটি আরও স্পষ্ট হয়। ১৯৭৩ সালে দলটি নিষিদ্ধ থাকায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দলটি ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে বৃহৎ মুসলিম লীগের সাথে একত্রিতভাবে ২০ টি আসন পায়।
এরশাদ সরকার আমলে ১৯৮৬ সালে দলটি ১০ টি আসন লাভ করে। বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে দলটি ১৯৯১ সালে ১৮টি আসন পায়। এছাড়াও ২০০১ সালে বিএনপির সহায়তায় দলটি ১৭টি আসনে জয়ী হয়। বিএনপি সরকার জামায়াত-ই-ইসলামীর বেশকিছু নেতাকে স্বাধীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতেও কার্পণ্য করেনি।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠিত সরকারের সময়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট দলটিকে পুণরায় সংসদ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করার পূর্বে ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন দলটি ৩ টি করে সংসদীয় আসন পায়। বর্তমানে জমায়াত-ই-ইসলামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড ঠিকই পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি এবং কিছু বৈদেশিক রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় যা অনভিপ্রেত।
যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের তৎপরতা:
২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বলে তার নির্বাচনী ইশতেহার তৈরী করে তখন জামায়াত-ই-ইসলামীর বিরুদ্ধে পরিস্থিতি আবার আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করে। তার নির্বাচনী বিজয়ের পর, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করলে এবং ১৯৭৩ সালের মূল আইনটি সংশোধন করলে ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়।
মূল আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংশোধন ছিল যে এটি “ব্যক্তিদের” পাশাপাশি “সংগঠন” এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপি সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অধিকাংশ জমায়াত-ই-ইসলামী নেতাদের রক্ষা করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখে। তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে সক্ষম হয়।
জামায়াত-ই-ইসলামীর রাজনৈতিক উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত:
প্রথমত জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সংবিধানে বিশ্বাস করে না। দ্বিতীয়ত দলটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য বড় অন্তরায়। যখনই দলটি বিএনপির মত বড় দলের সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় বসার সুযোগ পেয়েছে তখনই বাংলাদেশে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নিধনসহ অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু করেছে। এমনকি ক্ষমতার বাইরে থেকেও জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব থেকে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও বিশেষকরে হিন্দু সম্প্রদায় রক্ষা পায়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলে জামায়াত-শিবির ৫০ টিরও বেশি মন্দির ভাংচুর, ১৫০০ এর বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ধ্বংস করাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ ধ্বংস করে। সামনের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন তৎপরতা জামায়াত-বিএনপিকে পৃষ্ঠপোষকতা করারই ইঙ্গিত বহন করে।
সাম্প্রতিক এই মার্কিন তৎপরতা জামায়াত-বিএনপি আশির্বাদ মনে করলেও এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যত তথা জামায়াত-বিএনপি কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। এই কর্মতৎপরতার সারমর্ম বুঝতে হলে জামায়াত-বিএনপিকে ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং তালিবানদের প্রয়াত নেতা ওসামা-বিন-লাদেনের উত্থান-পতন অনুধাবন করতে হবে। বস্তুত ইরানকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যে সাদ্দাম হোসেনের উত্থান হয়েছিল সেই মার্কিন সরকারই তাকে তার চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সমস্ত ইরাকি জনতাকে।
রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে তালিবান নেতা ওসামা-বিন-লাদেনকে তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আবার তালিবানদের পতন এবং ওসামা-বিন-লাদেনকে হত্যা করে আফগানিস্তান দখল নেয়। মার্কিনিদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে-”বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু স্বার্থ চিরস্থায়ী।”একথা তাই সবারই জানা উচিত যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের হীন স্বার্থ হাসিল করার জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সার্বভৌমত্বে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে। এটি জামায়াত-বিএনপি আশির্বাদ মনে করলেও আসলে তা অশনি সংকেত।
যতদিন এদেশে যুদ্ধাপরাধী দলগুলো রাজনীতিতে সরব থাকবে ততদিনই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর থাকবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাই জনগণকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সঠিক রাজনৈতিক দল নির্বাচিত করার মাধ্যমে অশনি সংকেতের কঠিন পরিস্থিতির হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, সার্জারি ও থেরিওজেনোলজি বিভাগ, পরিচালক, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।