ড. মোবারক হোসেন
ধর্মের বিষয়টি বাঙালি জাতির জন্য একটি স্পর্শকাতর ব্যাপার। কারণ জেনে না জেনে কেউবা আবেগে বা অন্ধ বিশ্বাসে ধর্মের প্রতি একটু বেশি দুর্বল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাঙালি জাতির ইতিহাস শুরু হয় বহু বছর পূর্বে। কিন্তু ধর্মের কারণেই তাদের হতে হয়েছে বহু জাতি ও রাষ্ট্রে বিভক্ত।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনীতির একটি অংশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ ধর্মের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আর রাজনীতি করার কারণে রাজনীতিবিদরা ধর্মকে প্রশ্রয় দিয়েছে। একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায় দেখা যে তের শতক থেকে ১৮ শতক, এই সময়ের মধ্যে যারাই ক্ষমতায় এসেছে বা থেকেছে তাদের শাসনভারের পেছনে ধর্মের প্রভাব লক্ষ্যণীয়।
ভারতের পশ্চিমে আরব অভিযান আব্রাহামীয় মধ্যপ্রাচ্য ধর্মীয় ব্যবস্থা, দক্ষিণ ভারতে হিন্দু সমাজের বিস্তার লাভ এবং সুলতানি শাসনের উন্মেষ। এগুলোর পেছনে ধর্মের নীতিবাক্য ও প্রচার বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এইভাবে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিরোধ কংগ্রেসের হিন্দু ঘোষণা নীতি ভারত বিভক্তিকে অনিবার্য করে তোলে।
যার ফলে বৃষ্টি হয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এভাবে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও তা ভাগ হয়ে যায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে। পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জন হয় বাঙালি জাতির।
তবে স্বাধীনতার ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র, তার ভিত্তি কোন বিশেষ ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যা ১৯৭২ সালে সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, প্রথমত ধর্মভিত্তিক, দ্বিতীয়ত ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্ম বলতে বুঝানো হয় আদর্শগত বিষয় যেমন মুসলমান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম, খ্রিস্টান যিশু খ্রিস্টের, বৌদ্ধ গৌতম বুদ্ধের এভাবে প্রতিটি জাতি তার ধর্মের অনুসরণ করা এবং অগ্রাধিকার দেয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বলতে বুঝায়, ধর্ম আর রাজনীতি একীভূত করে ধর্মের নামে রাজনীতি করা।
আর ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বুঝানো হয় যেখানে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের স্বাধীনতা থাকবে, প্রত্যেকে স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং ধর্ম পৃথক রূপে প্রকাশ করা অর্থাৎ রাষ্ট্রকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করাকে বোঝানো হয়। রাষ্ট্রের আইন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকে না। ধর্মনিরপেক্ষতা সকল ধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টি ও সুযোগ রাখে।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছিল আমাদের। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বহু দল থাকলেও নিবন্ধিত দলের সংখ্যা প্রায় ১০ টির বেশি নয়। যার মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম, ইসলামিক ঐক্যজোট, খিলাফত মজলিস উল্লেখযোগ্য। তবে এদের মধ্যে বেশি সক্রিয় দেখা যায় জামায়াতে ইসলামকে। তবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম জ্বালাওপোড়াও, গুম, হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা সৃষ্টি প্রভৃতি আদৌ কি তাদের ধর্ম সমর্থন করে?
তারা তাদের রাজনীতিতে ধর্মের সাফাই গেয়ে যে বাণী প্রচার করেন আদৌ তাদের সেই নীতি বাক্যের সাথে কার্যকলাপের কোন মিল পাওয়া যায়?
ইসলামী দলগুলোর আদর্শিক ব্যক্তি হলেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক, ইসলামী ভাবধারার প্রবর্তক এবং একজন আদর্শিক ব্যক্তি। কিন্তু তার রাষ্ট্রনীতিতে ছিল না কাউকে অন্যায় ভাবে কষ্ট দেওয়া, রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, রাষ্ট্রের ভেতর অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা।
ধর্মভিত্তিক দলগুলো আদৌ কি এই বিষয়গুলো অনুসরণ করে, বরং তারা আরও এর বিপরীত করে জাতি ও রাষ্ট্রের ভেতর আতঙ্ক ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তারা বিভিন্ন সময় কর্মসূচির নামে নৈরাজ্যতা সৃষ্টি করে আসছে, দৈনিক পত্রিকার বিভিন্ন সময়ের সংবাদ বিশ্লেষণ করলে আমরা এর নমুনা দেখতে পাই।
২০০০ সালের ২০ শে জুলাই গোপালগঞ্জে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এক জনসভায় হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখা হয়। তবে পরবর্তীতে তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ২০০৪ সালের একুশে মে সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের উপর হামলা ।
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়, যাতে ২৪ জন নিহত এবং ৩০০ জন আহত হয়। ২০০৫ সালে ১৭ই আগস্ট সারাদেশে ৩০০ স্থানে সিরিজ বোমা হামলা হয়। ২০১৩ সালে ব্লগার রাজিব কে হত্যা করা হয়।
২০১৬ সালে পহেলা জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজেনে হামলা হয়। এতে দেশি-বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যা করা হয়। এ সকল ঘটনা তদন্ত করে দেখা যায় এসব হামলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ইসলামী ভাবধারার লোকজন জড়িত। যাদের অনেকে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর মদদপ্রাপ্ত ।
এখন বিষয় হল তাহলে বাংলাদেশের বড় দুটি দল নির্বাচনের সময় সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে টানাটানি কেন করে। অথচ তারা সংখ্যায় কম। অপরদিকে জাতীয় নির্বাচনের সময় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এলাকাভিত্তিক সেই ধর্মীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন বা নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণ হিসাবে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর বাহাদুর উশৈ সিং, এবং খুলনা-১ আসনের ননীগোপাল মন্ডলের কথা উল্লেখ করতে পারি।
বিবিসি নিউজের এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেছেন, সব মত পথের মানুষকে কাছে রাখতে চাওয়াটাই একটি রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক লক্ষ্য। তবে নির্বাচনের সময় দলের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে নানা অপপ্রচার হয় সেটি যেন না হয় সে চেষ্টা থেকেই ইসলামী দলগুলোকে সাথে রাখা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার এবং সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপের বিধান থাকলেও বাস্তবে এর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যার কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই নৈরাজ্যের পথে হাঁটছে।
দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময়ের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়ানে বাঙালির স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে এখন দুই ভাগে বিভক্ত। ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায়িক সহাবস্থান, বিশ্বাসবোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জনগণ। দ্বিতীয়ত ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে সিদ্ধ হস্ত প্রগতিবিরুদ্ধ জনগণ।
যাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আজ জ্বলছে গোটা বাংলাদেশ। সৃষ্টি হচ্ছে ধর্ম বর্ণের ভেদাভেদ, হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ। পুরো দেশে অশান্তি বিরাজমান, আস্তানা করে বসতে শুরু করেছে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী, যা দেশকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে এক অস্থিতিশীল পরিবেশের দিকে।
তাই প্রগতিবিরুদ্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে নিবিষ্ট, প্রতিহিংসাপরায়ন, রাজনৈতিক এই অপশক্তিকে রুখতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে একটি একক ধারায় দেশ ও জনগনকে নিয়ে আসা, যে ধারা প্রতিনিধিত্ব করবে উদার গণতান্ত্রিক ও নানা ধর্ম মতে পারস্পরিক সহ অবস্থানের চেতনার।
আর এই জন্য প্রথমেই যে পদক্ষেপের দরকার তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। কোন কারণে যেসব লোক আজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে হয়ে উঠেছে দেশ ও মানবতা বিরোধী তাদের শুধরে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। সর্বোপরি দেশে গণতান্ত্রিক ধারা সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।