ড. সুরাইয়া আক্তার
‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান-বাড়রে কর্মসংস্থান’—শ্লোগান নিয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে।
ইশতেহার ঘোষণাকালে টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার চলমান প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার দৃঢ় প্রত্যয় আবারও ব্যক্ত করেন।
এবারের ইশতিহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, তরুণ প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিজ্ঞানলব্ধ শিক্ষা ও কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে দৃশ্যমান অবকাঠামো ও সুযোগ বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ ১১টি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে ।
এ সকল কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে ৩৩তম অর্থনীতির দেশ থেকে ২০৩১ সালের মধ্যে ২০তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা উপস্থাপিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এমন স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এদেশের মানুষের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল, তার কন্যা সেই বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিজের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবেন এটিই যেন স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে এদেশের মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। কিন্তু চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সহজ নয়।
এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির চর্চা। টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিতে যে উন্নয়নের ধারা প্রবহমান, তা রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল পরিবেশের ফসল বলেই প্রতীয়মান। কিন্তু এটিও সত্যি যে, ৫২ বছরে পদার্পণকারী দেশটি পিছিয়েছে বারবার।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে যবনিপাত ঘটে।
পরবর্তী সময়ে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের হাতে অর্থনীতি ও সামাজিক অবকাঠামো দুর্বল হয়ে পরে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বুকে আঘাত আসে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় এই পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটে। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে পরিবর্তন এনে আইনের শাসন ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র বিমোচন, চিকিৎসা সেবার উন্নয়নের মাধ্যমে গড় আয়ুষ্কাল সূচক বৃদ্ধি ছিল দৃশ্যমান।
আওয়ামী লীগ পাঁচ বছরে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার সুযোগ অবারিত করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বয়স্কভাতা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত মহিলা ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান ও কমিউনিটি ক্লিনিক করে স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক মানুষের দোর গোঁড়ায় পৌঁছে দিয়ে জীবনমানের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে দেশকে দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত করতে সক্ষম হয়। এর সাথে আশ্রয়ণ প্রকল্প, গৃহায়ণ ও আদর্শ গ্রাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছিল বাংলাদেশকে মানবাধিকার ও টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেয়ার অনন্য প্রচেষ্টার অংশ।
নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ এবং নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণের ব্যবস্থা ছিল নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় কাজ। এর সাথে উল্লেখ করতে হয় যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসনের উচ্চপদে নারীর পদায়ন এবং পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নিয়োগ ছিল অভূতপূর্ব। নারী ও শিশুর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও পারিবারিক নির্যাতন রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়গুলোও উল্লেখের দাবী রাখে।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল, তাতে ছেদ পড়লো বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সরকারের ক্ষমতারোহনের মধ্যদিয়ে। এ সময়ে জাতিকে দেখতে হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা! বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের বিরোধীদের নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণকারী দল যে দেশপ্রেমিক হবে না, দেশের উন্নয়ন ও মানুষের উন্নয়নের প্রতি আগ্রহী না হয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থ পাচার, লুটতরাজ ও হত্যার রাজনীতি করবে- এটাই স্বাভাবিক।
এদেশের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তির অধীনে দেশটি আবার নিমজ্জিত হলো নানাবিধ অস্থিরতায়। এই সরকারের আমলে জনগণের মৌলিক অধিকার ও জানমালের নিরাপত্তার অভাবের পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নানাবিধ অত্যাচার প্রতিদিনের খবরের কাগজের শিরোনামে স্থান পেতে থাকে। জনগণের উন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন প্রাধান্য দেয়া হয়।
এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ইতিপূর্বে গৃহীত পদক্ষেপগুলো অন্ধকারে চলে যায়। তথাপি ক্ষমতা ধরে রাখার পন্থা হিসেবে তৎকালীন সরকারের আজ্ঞাবাহী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। এ সময়ের এবং তৎপরবর্তী মাইনাস ফর্মুলার ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। কথা হলো ২০০৯ সালে দেশের মানুষ আবার নৌকায় বিপুল পরিমাণে ভোট কেন দিয়েছিল?
উন্নয়নের হারিয়ে যাওয়া ধারাকে ফিরে পাওয়ার জন্য। দেশের মানুষ একটি অসাম্প্রদায়িক, উন্নত, সমৃদ্ধ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর দেশ চায়। তাই ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুত ‘দিন বদলের সনদ’ এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল এদেশের মানুষের প্রত্যাশা। টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ সরকার ইতিমধ্যে জনগণের এই প্রত্যাশা পূরণ করে ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, তা বাস্তবায়ন এই দলটির ক্ষমতায় আসার মাধ্যমেই সম্ভব।
এদেশের উন্নয়নের ইতিহাস এর পক্ষেই প্রমাণ দেয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি রমরমা অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সময়ের দাবী। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। তবে এটিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন, শুধু অবকাঠামোর দিক থেকে উন্নত এবং প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র হলেই একটি মানবিক রাষ্ট্র হবে- তা নয়। কেননা উন্নয়ন সর্বদা সকলের জন্য কল্যাণকর হয় না বরং তা মাঝে মাঝে সমাজে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়ায়।
এটি পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থার একটি অনির্ধারিত ফল। তাই প্রযুক্তিজ্ঞানলব্ধ অর্থনীতি নির্ভর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই টেকসই ও উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের সমতা ও সক্ষমতা তৈরির পাশাপাশি সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে সকলেই উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যকার আর্থিক ও সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনা, তরুণ প্রজন্মকে মাদকাসক্তির ছোবল থেকে রক্ষা করে সুস্থ ও কর্মমুখী করা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিজ্ঞানহীন প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত ব্যবস্থাগুলোকে আরও কার্যকর করা ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও অন্যান্য পর্যায়ে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে দেশটি সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অপর একটি দল আরও কয়েকটি দলকে সাথে নিয়ে একদিকে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রদর্শন, নির্বাচনকে ঘিরে জালাও- পোড়াও কর্মকাণ্ড সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজটিকে দুরূহ করে তুলেছে অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রশ্নে অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।