বিপ্লব কুমার পাল
এবছর দেবী দুর্গা মর্ত্যে এসেছিলেন ঘোটকে চড়ে। ফিরেও গেছেন ঘোটক। সনাতন শাস্ত্রমতে, দুর্গা যদি ঘোটকে চড়ে আসেন এবং বিদায় নেন তবে তার ফল ‘ছত্র ভঙ্গ স্তুরঙ্গমে’ অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও যুদ্ধ সংক্রান্ত অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দুই দেশে যুদ্ধ হতে পারে। সামাজিক ও রাজনৈতিকস্তরে ধ্বংস ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু দেবী দুর্গা যেমন দুষ্টের দমন করেন তেমনি শিষ্টের পালনও করেন। তিনি কল্যাণময়ী বরাভয়দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করতেই পৃথিবীতে আসেন।
দেবী দুর্গার ঘোটকে আগমন ও গমন নিয়ে অস্থিরতার শঙ্কায় ছিলেন বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বীরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে বাঙালি হিন্দুদের বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে নাশকতা-সহিংসতার আশঙ্কাও করেছিলেন কেউ কেউ কেউ। কারণ অনেক বার নির্বাচনের আগে এক পক্ষ সনাতন ধর্মালম্বীদের ভয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বাড়তি চিন্তা ছিল সকলের। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “২০২১ সালে দুর্গোৎসবে হামলার পর ২০২২ সালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেনি। এতে প্রমাণিত হয়, সরকার চাইলে দুর্গাপূজায় হামলা হবে, না চাইলে হামলা হবে না; এটাই বাস্তবতা। তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলকে এক হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।” এছাড়া কয়েটি স্থানে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায় সবার মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এরও যথেষ্ট কারণ আছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর যে বীভৎস নির্যাতন হয়েছে তার ক্ষত এখনও দগদগে। এছাড়া ২০২১ সালের কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে হামলা হয়েছিল। পরবর্বতীতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন জেলায়। আবারও সেই ষড়যতন্ত্র হতে পারে এমন শঙ্কাও ছিল।
দুর্গাপূজার আয়োজন এবছর শুধু সংখ্যায় বেশি ছিল না, ছিল প্রাণভরা উৎসবের পরশ। ভারতের পশ্চিবঙ্গ নয় বাংলাদেশেই এশিয়ার সবথেকে বড় দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছে। এক মণ্ডপে ৫০১ টা প্রতিমা। ব্যক্তি উদ্যোগে বাগেরহাটের সিকদার বাড়ির পুজায় ঢল নেমেছিল হাজার হাজার দর্শানার্থীর। শুধু বাগেরহাট নয়, সারাদেশেই এক উৎসবের সুতোয় বেধেছিল। যেখানে ধর্ম-বর্ণ মিশেছিল একই রঙে।
এক সময় দুর্গাপূজা এতোটা সর্বজনীন ছিলনা। রাজা-জমিদারেরা এই পূজা করতেন। সাধারণ প্রজাদের অংশগ্রহণ ছিল না। রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায় ষোড়শ শতকে আট লাখ টাকা খরচ করে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৪৮০ সালে সেখান দুর্গামন্দির স্থাপন করা হয়। ইতিহাস বলছে, সেই থেকে শারদীয় দুর্গাপূজা রূপ নেয় বাঙালির উৎসবে। স্বাধীনতার পর থেকে ঐতিহ্যবাহী ওই মন্দিরটি একটি চক্র দখল করে রেখেছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মন্দিরটি দখল মুক্ত করে। সেই থেকে তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায়ের আদি মন্দিরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। এবছরও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে দুর্গোৎসব। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, ভারতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক ভক্ত এসেছে এখানকার দুর্গাপূজা দেখতে। যে উৎসব বাঙালি হিন্দুদের এক সুতোয় বেঁধে রাখে তার সূচনামন্দির দর্শনই বড় প্রাপ্তি বলে জানিয়েছেন ভক্তরা।
দেশের সব প্রান্তেই লেগেছিল উৎসবের রঙ। রাতভর প্রতিমা দর্শন, আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া, বাড়িতে বাড়িতে নাড়ু-মোয়ার গন্ধে মৌ মৌ করেছে। রাত ২ টায় মন্দিরে মন্দিরে ছিল দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। মন্দিরে কয়েজন আনসার সদস্য, একজন পুলিশ দায়িত্ব পালন করেছেন ঠিকই। কিন্তু সবার চাওয়া ছিল নিরাপদে পূজা উদযাপনের। যেমন সনাতন ধর্মালম্বীরা সচেতন ছিলেন, তেমনি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষে বুক আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে কোনো ষড়যন্ত্র রুখতে। আরেকবার বাঙালি প্রমান করেছেন, যে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার জন্য জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, সেই পথেই চলেছে লাল-সবুজের প্রিয় দেশ।
সারাদেশ মোটামোটি দিনের আলোতেই প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। শুধু ব্যতিক্রম নাটোর। বহু বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। সন্ধ্যার পর এখানে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। যতই সংকট আসুক কখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এর একটি কারণ আছে। বিজয় দশমীর দুপুরের পর থেকে নাটোর শহরের খাবারের দোকান ছাড়া সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। প্রতিটি পূজা মণ্ডপ থেকে দেবীকে তোলা হয় ট্রাকে। বৈদ্যুতিক বাতিতে সেজে ওঠ ট্রাক। বাদ্র্য যন্ত্র আর গানের তালে তালে শুরু হয় প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা। যেখানে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী তো আছেই, বৃদ্ধরাও বাদ যান না এই আনন্দ শোভাযাত্রা থেকে। যেখানে ধর্মের চেয়ে প্রতিবেশি-বন্ধ পরিচয় সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। সংখ্যার হিসেবে ৭০ ভাগ অংশগ্রহণকারী থাকেন মুসলিম সম্প্রদায়ের। তারও এই আনন্দ উপভোগ করতে বছরজুড় অপেক্ষা করেছেন। বছরের পর বছর এই দশমী শোভাযাত্রা হয়ে আসছে, হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু কখনো অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই। এই শোভাযাত্রা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন মিলন মেলা।
এ বছর বুক উচিয়ে নিরাপদে সনাতন ধর্মের মানুষ উৎসব উদযাপন করেছেন। আর এই সাহস পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। প্রধানমন্ত্রী সনাতন ধর্মালম্বীদের বলেছেন, ‘নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। এখানে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলে কোনো কথা নাই। এ দেশে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা যে ধর্মেরই হোক, কেউই সংখ্যালঘু নয়। সব রক্তের রং লাল। মুক্তিযুদ্ধে সবার রক্ত মিশে গেছে এক স্রোতে। তাই এই দেশ সবার। বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। এখানে সকল ধর্মের মানুষ যার যার ধর্ম, সে সে পালন করবে। ধর্ম যার যার, উৎসব সকলের। আমরা সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে উৎসবে সামিল হতে চাই।’
সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাঙালিদের বাঁচাতে বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারই প্রতিবিম্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে। এটি শুধু তার মুখের কথা নয়, তার বিশ্বাসও। যদিও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এবছরের দুর্গাপূজা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার সেই আশঙ্কা মিথ্যা প্রমান করেছেন বাংলাদেশের মানুষ। পাঁচ দিনের দুর্গোৎসবে মেতেছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতি একত্রিত থাকলে যে কোনো ষড়যন্ত্র তুচ্ছ তারই আরেকটি উদাহরণ এবারের দুর্গাপূজা। যেখানে ছিল না ধর্মের ভেদাভেদ, ছিলনা ধনী-গরীবের ব্যবধান।
ত্রিনয়নী দেবী দুর্গা দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালন করেন। দুর্গা মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য-বীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী), মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক। দেশের অশুভ শক্তি বিনাশ করে সত্য ন্যায় এবং সকলের কল্যাণ বয়ে আনবে দেবী দুর্গা এবং আগামী বছরে দেবীকে বরণ করতে শুরু হয়েছে ক্ষণগণনা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।