বিপ্লব কুমার পাল
টানা দুই দিনের হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে ষষ্ঠ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১ দফা দাবিতে নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি ছাড়াও তাদের সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোসহ অন্যান্য সমমনা বিরোধী দলও এই অবরোধ সমর্থন করে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করবে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা ও পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এর আগে পাঁচ অবরোধ ও দুই হরতাল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।
কয়েকটি দাবির সমন্বয়ে এক দফা
২০১৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর নির্বাচনের ফলাফল বয়কট করেছিল বিএনপি। কিন্তু সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে ৬ নির্বাচিত ও একজন সংরক্ষিত মোট সাত জনকে সংসদে পাঠিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরবর্তীতে সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সাতজন সংসদ সদস্যই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। সেই সাথে দলীয় ভাবে বিএনপি রাজপথেই সকল দাবির উপর আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঈদের পর আন্দোলন, ৩১ দফা, ১৪ দফা, ৪ দফা এবং ১ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। কিন্তু আন্দোলন কর্মসূচিতে দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ থাকলেও জনসম্পৃক্ততা ছিল না। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের দাবিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামে বিএনপি। কিন্তু সেখানেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিএনপি রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের দিকে ধাবিত হলেও সেখানেও ব্যর্থ হয়। বারবার দফা পরিবর্তন করায় হতাশ হয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সবশেষ বুধবার ও বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচিতেও এক দফার নামে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি দফা। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব জানিয়েছেন- সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১ দফা দাবিতে ষষ্ঠ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে। অথচ ওই এক দফার মধ্যে বড় বড় তিনটি দফা রয়েছে। এনিয়ে খোদ বিএনপির কর্মীরা হাসি ঠাট্টা করছে। তারা বলছেন, যদি দফা তিনটিই হয় তাহলে তিন দফা বলতে অসুবিধা কোথায়? খামাখা একটি দফার কথা বলার কি দরকার?
বিদেশি শক্তির ভরসায় বিএনপি হুঁশিয়ারি
নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরের শুরু থেকেই দেশে বিদেশি তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। একের পর এক পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিএনপি প্রীতিও এখন কারো অজানা নয়। রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতাদের সাথে। এমনকি সরকারকে চাপে ফেলতে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ শর্তহীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে আহবান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধা তুলতে পারেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের সময় ফুরিয়ে গেছে বলে সংলাপের আহবান প্রত্যাখান করা হয়। বর্তমানে বিদেশি তৎপরতার সকল চেষ্টাই আপাতত শেষ বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপি এতদিন যে বিদেশিদের ঘাড়ে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল সে আশারও গুড়েবালি।
শেষ পর্যন্ত আন্দোলন নাকি নির্বাচন?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির আর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই, এরকম ভাবার কোন অবকাশ নেই। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে এবং পুনঃ তফসিলের আবেদন করে তাহলে অবশ্যই তাদের আবেদন বিবেচনাসাপেক্ষে ভোটের দিন নতুনভাবে নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে। যেমনটি নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখনো যেসব রাজনৈতিক দল আসেনি তারা যদি আসতে চায় তাহলে আইন মেনে তাদের নির্বাচনে আসার পথ তৈরি করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে ভোটের তারিখ পেছাতে আপত্তি নেই বলেও জানায় নির্বাচন কমিশন।’
তফসিল ঘোষণা হলেও পুনঃতফসিল ঘোষণা করে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইতিহাস আছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনের তারিখ আরও ১১ দিন পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করতে পুণরায় তফসিল ঘোষণা করা হয়। একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, ৮ নভেম্বর ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষণায় ২৩শে ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর পুনঃতফসিলে তা পিছিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর নির্ধারিত হয়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিতে পারে বিএনপি। তা নাহলে দলটির অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। কারণ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে তারা। স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন নির্বাচন বয়কট করায় তৃণমূলের অনেক বিএনপি নেতা নাখোস কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর। এছাড়া বিএনপির ঘাড়ে এবার নিশ্বাস ফেলছে নতুন নিবন্ধন পাওয়া দল তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বি.এন.এম)। দল দু’টি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে বহু নেতাই তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম-এ যোগ দিতে পারে। তাই আন্দোলন কর্মসূচিতে ব্যর্থতার পর অস্তিত্ব রক্ষায় বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নিশ্চয়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেটি ভাবছে। কথায় আছে- ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই।’ তাই শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপিও চমক দেখাতে পারে- সে কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।