খান মুহাম্মদ রুমেল
ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। নানা কারণেই এখন আলোচনার কেন্দ্রে। রাজনৈতিক নেতাদের মতো প্রায় প্রতিদিনই খবরের শিরোনাম হচ্ছেন তিনি। কখনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গিয়ে কখনো, সরকারের বিভিন্ন দফতরে গিয়ে অযাচিত কথা বলে পরে আবার তা অস্বীকার করে নিজেকে আলোচনায় রাখছেন পিটার হাস।
যুগ যুগ ধরে যে আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভিসা দিয়ে আসছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গেলো ২৪শে মে সেটিই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করে দেশটির পররাষ্ট্র দফতর। বলা হয় গণতন্ত্র, অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার রক্ষায় যারা বাধা তৈরি করবে তারাই পড়বে ভিসানীতির আওতায়। ২৪ মে এই ঘোষণার চার মাসের মাথায় ২২ সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকরের ঘোঘণা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । এর দুদিনের মাথায় ২৪ সেপ্টেম্বর পিটাস হাস মন্তব্য করেন গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরাও আসবেন ভিসানীতির আওতায়। পিটার হাসের এমন মন্তব্যের ঝড় উঠে দেশে বিদেশে। তার এমন মন্তব্যকে স্বাধীন গণমাধ্যম ধারণার পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেন কেউ। পিটার হাসের মন্তব্য নিয়ে যখন সমালোচনার ঝড়, তখন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এনিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, এমনটা তারা ভাবছেন না।
এ তো গেলো মাসখানেক আগের কথা। কিন্তু এরপর থেকেও অদ্ভূত কাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন পিটার হাস। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের তিন কয়েক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিএনপির সমাবেশের দিন রাস্তা বন্ধ করা হবে কি না, বিএনপি কর্মীদের সমাবেশে আসতে বাঁধা দেয়া হবে কি না, ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানতে চান। জানতে চান দুর্গাপূজা সম্পর্কেও। পরে এনিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তুলে ধরেন বৈঠকের বিস্তারিত। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন পিটার হাসও। এই পর্যন্ত ছিলো সব ঠিকঠাক। কিন্তু ওই দিন রাতের বেলা এক বিবৃতি পাঠায় মার্কিন দূতাবাস। দাবি করেন, বিএনপির সমাবেশ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়নি। এনিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিলে চুপ করে যায় মার্কিন দূতাবাস।
গেলো বেশকিছু দিন ধরেই বিএনপি জামায়াতসহ আরো কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে চলেছেন পিটার হাস। কখনো দূতাবাসে, কখনো নিজের বাসভবনে আবার কখনো কোনো রেস্টুরেন্টে হচ্ছে এসব বৈঠক। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কি এতো আলোচনা পিটার হাসের? গণমাধ্যমকর্মীরা এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরাবরই এড়িয়ে যান পিটার হাস। কোনো কোনো জায়গায় আবার গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি নাকি তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি – এমন খোঁড়া যুক্তি হাজির করার চেষ্টা করেন পিটার হাসের নিরাপত্তা টিমের পক্ষ থেকে।
এই তো কিছুদিন আগে গুলশানে এক সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলে বসলেন, পিটার হাস বিএনপির কাছে অবতার। শাহজাহান ওমরের ভাষায়- বাবা পিটার হাস, তুমি আমাদের বাঁচাও। আচ্ছা, একটা দেশের রাষ্ট্রদূত- কোনো একটা রাজনৈতিক দলের কাছে অবতার বা দেবতা হয়ে ওঠেন কিভাবে? কূটনৈতিকদের জন্য প্রযোজ্য ভিয়েনা কনভেনশন কি বলে? স্বাগতিক দেশে কোনো রাষ্ট্রদূত কি তার নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, নাকি কোনো রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টা কিংবা প্রচার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন!
বাংলাদেশের রাজনৈতিক রীতি অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দল সভা সমাবেশ ডাকলে পুলিশের অনুমতির জন্য দলের প্রচার সম্পাদক অথবা দফতর সম্পাদক কিংবা অন্য কোনো নেতাকে পাঠায়। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিএনপির বড় কোনো কর্মসূচি বা অন্য কোনো ইস্যু সামনে এলেই স্বরাষ্ট্র কিংবা আইনমন্ত্রীর কাছে গিয়ে হাজির হোন পিটার হাস। এসব ক্ষেত্রে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, পিটার হাস কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূত নাকি বিএনপির দূতিয়ালি করার জন্য ঢাকায় এসেছেন? তার এসব কর্মকাণ্ড দেখে রাজনৈতিক রসিকজনদের কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করছেন পিটার হাস কি বিএনপির উপদেষ্টা, প্রচার সম্পাদক নাকি খণ্ডকালীন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন?
২০২১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জন বাংলাদেশের জন্য একটি শোকের দিন। এদিন সরকারের কোনো দফতরকে না জানিয়ে গুমের শিকার বলে অভিযোগ তোলা একজনের বাড়িতে গেলেন পিটার হাস। পিটার হাসের উপস্থিতির খবর পেয়ে তেজগাঁওয়ের নাখাল পাড়ার সেই বাড়ির সামনে গিয়ে জড়ো হলেন, ৭৭ – কথিত সামরিক বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা। তাদের আর্তনাদে ভারি আশপাশ। পিটার হাসের কাছে তারা তুলে ধরার চেষ্টা করেন স্বজন হারানোর বেদনার কথা। বিচার ত্বরান্বিত করার দাবিও তোলেন কেউ কেউ। আর সাংবাদিকতার খুব সাধারণ নিয়মেই খোঁজ পেয়ে সেখানে হাজির হন গণমাধ্যমকর্মীরাও। এইখানেই বাঁধে গোল। পিটার হাস তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বগ্ন হয়ে পড়েন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সেই উদ্বেগ জানানও তিনি। কিন্তু কথা হলো সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে না জানিয়ে তিনি কোথাও গেলে, কিংবা যাওয়ার পর বিব্রত হলে সে দায় কার? আর সাংবাদিকরা সেখানে গেলে তার এতো বিব্রত হওয়ার হেতুই বা কি?
আচ্ছা একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গণতন্ত্র ও মানবতার কথা। মানবতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই নাকি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তারা। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে উঠে আসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বজুড়ে তাদের মানবতা হরণের নজির। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছেন- লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদের আলেন্দেকে হত্যার মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন দেশটির ওপর চাপিয়ে দিয়োছিলো সামরিক স্বৈরতন্ত্র। শুধু এই একটি নয়, কমপক্ষে বিশ্বের পাঁচজন নির্বাচিত সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা ও উৎখাতের অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। নিজের দেশের মানুষের কাছে পাহাড়সম জনপ্রিয়তায় থাকা কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে বছরের পর উৎখাতের ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজের বেলায়ও ছিলো একই নীতি। এছাড়া আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক ও ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসণের স্মৃতি এখনো মানুষের মনে জ্বলজ্বলে। বিশ্বের কোটি কোটি নীপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের রক্ত লেগে থাকা হাত উচিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্রের সবক দেয়, এরচেয়ে বড় উপহাস আর কি হতে পারে?
যাই হোক যারা পিটার হাসকে অবতার ভেবে তার কাছে পরিত্রাণ খুঁজছেন, সময়ই বলে দেবে কতোটা পরিত্রাণ পাওয়া গেলো তার কাছে কিংবা তার দেশের কাছ থেকে। কিন্তু ইতিহাস বলে মার্কিন বন্ধু হলে আর শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না!
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।