এই উপমহাদেশের জনমানসে পুলিশ বহুকাল ধরিয়া বহু ক্ষেত্রেই মূর্তিমান আতঙ্কের অপর নাম। পুলিশ লইয়া প্রবাদ রহিয়াছে যে, বাঘে ছুঁইলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁইলে ছত্রিশ ঘা। অথচ পুলিশ শব্দের প্রথম ‘পি’ অক্ষরের অর্থ হইল পোলায়েট—অর্থাত্ নম্রভদ্র। বাকি শব্দগুলির অর্থও দারুণ আশা-জাগানিয়া। তাহা হইল—বিনয়ী, বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান, সাহসী ও দক্ষ। শিল্পোন্নত দেশে ইহা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পুলিশের এই শব্দগত বৈশিষ্ট্য ভিন্নভাবে উপস্থিত; যেমন বেশির ভাগ ক্ষমতাহীন ও গরিব মানুষের অভিজ্ঞতায় পুলিশ কখনোই বিনয়ী ও বিশ্বস্ত নহে। বুদ্ধিমান, সাহসী ও দক্ষ নিশ্চয়ই। তবে তাহা অন্যকে হেনস্তা করিবার ও ঘুষ খাইবার ফন্দিফিকির বাহির করিবার ক্ষেত্রে। অন্তত তেমনটিই উঠিয়া আসিয়াছে গত বৃহস্পতিবার ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, টাকা কিংবা ক্ষমতা না থাকিলে মিলে না পুলিশের সেবা। অধিকাংশ থানায় জিডি করিতে গেলেই টাকা লাগে। মামলার বাদী-বিবাদী উভয়ের নিকট হইতেই টাকা নেওয়া হয়। তদন্তের নামে চলে অর্থ উপার্জন। পুলিশের এই অবস্থা শুধু এই সরকারের আমলে নহে, বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও একই চিত্র ছিল। তখনো রাজনৈতিক নেতাদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহূত হইত পুলিশ। এখনো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক নেতার হইয়া কাজ করিতেছে থানা পর্যায়ের পুলিশ। এমনকি নিরীহ-অসহায় মানুষের জায়গা-জমি দখলও করিতেছে।
থানা মানে টাকা ব্যতীত কোনো কাজ হয় না—ইহা সাধারণ মানুষের মনে গাঁথিয়া গিয়াছে। এমনকি টাকার মাধ্যমে তদন্তও উলটাইয়া যায়। যাহারা আসামি তাহারা টাকা দেয়, আর খালাস পায়। এইভাবে অনেক অপরাধীও ছাড়া পাইতেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরেও কেন পুলিশের মধ্যে শব্দগত বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হইবে না? দুর্যোগে বা বিপদে পুলিশের নিঃসন্দেহে অসাধারণ অনেক অবদান রহিয়াছে। জাতির ক্রান্তিকালে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা মানুষের পাশে থাকিবার দৃষ্টান্ত পুলিশের রহিয়াছে। করোনার সময় সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা দারুণভাবে প্রশংসিত হইয়াছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দামাল পুলিশ সদস্যদের দুঃসাহসী ভূমিকা ও আত্মত্যাগ আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে। এখন তো ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলের পুলিশ নহে, স্বাধীন দেশের পুলিশ। তাহা হইলে পুলিশের সত্যিকারের যাহা যাহা বৈশিষ্ট্য, তাহা উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশের পুলিশের কেন থাকিবে না?
এইখানে সমস্যা মূলত দুইটি। একটি মানসগত তথা দৃষ্টিভঙ্গিগত। ইংরেজি শাসন আমলে ১৮৬১ সালে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হইয়াছিল প্রজাদের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার জন্য। প্রথমে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করা হয়, তাহার পর সেই লাঠিয়াল বাহিনীই পুলিশ বাহিনীর রূপ লাভ করে। তখন এসপিদের বলা হইত ‘কোতোয়াল’ এবং কোতোয়ালের অফিস জেলা সদরে থাকিত বিধায় জেলার সদর থানাকে বলা হইত কোতোয়ালি থানা। এসআই/সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসারকে বলা হইত ‘দারোগা’। মজার ব্যাপার হইল—দারোগা শব্দের আভিধানিক অর্থ—‘বলপ্রয়োগকারী’ বা ‘জুলুমবাজ’। এই দারোগারাই বল প্রয়োগ কিংবা জুলুম করিয়া খাজনা আদায়ে নেতৃত্ব দিত। এখনো জনমানসে পুলিশের ‘জুলুমবাজি’ এই ভাবমূর্তি রহিয়া গিয়াছে।
দ্বিতীয় সমস্যা হইল, এখন একজন ওসির পোস্টিং লইতে গেলে আনঅফিশিয়ালি মোটা অঙ্কের টাকা লাগে। সেই টাকা উঠাইতে ঘুষ ছাড়া উপায় নাই। সুতরাং বাদী-বিবাদী উভয়ের নিকট হইতেই তাহারা টাকা নেয়। জমি লইয়া সালিশি কাজ করিবার বিধান নাই, তাহার পরও সেই কাজ করিয়া ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করিতেছে পুলিশ। সম্প্রতি তুরাগ থানার এক এসআইয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারি ধরা পড়িয়াছে—যেইখানে তাহার ছিল নিজস্ব আদালত। সেই আদালতে কে কত কিস্তিতে ঘুষের টাকা দিবে—তাহা নির্ধারণ করা হইত। পোস্টিং নিয়ন্ত্রণের সিন্ডিকেট রহিয়াছে। তাহারা কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। পুলিশে যোগ্যতা, সততা, জ্যেষ্ঠতার মূল্যায়ন করিতে হইবে। সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করিতেছে, কিন্তু এই সিন্ডিকেটের কারণে মানুষ পুলিশ হইতে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাইতেছে না। সুতরাং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় হইতে ইহার একটি ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।