গত ৪ মার্চ এস আলম গ্রুপের গোডাউনে লাগা আগুনে অপরিশোধিত চিনি গলে গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে ইছানগরে নদীর লাগোয়া এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান। এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে বর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।
আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর রিফাইন্ড চিনি পরিণত হয়েছে বিষাক্ত বর্জ্য।ে এ বর্জ্য গিয়ে পড়ছে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে। এ বর্জ্য রীতিমতো অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট লাভার রূপ নিয়ে নদীতে পড়ার পর এখন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে ভেসে উঠেছে মৃত ও অর্ধমৃত মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণী।
এ ঘটনা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে নদীতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব যেমন পড়বে তেমনিভাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন কর্ণফুলী পাড়ের মানুষের শারীরিক ক্ষতির। টানা দুদিন এস আলম গ্রুপের কারখানার অপরিশোধিত চিনি পোড়া রাসায়নিক নদীতে পড়ার ফলে ভেসে ওঠা মাছ ধরছে দুই পাড়ের শত শত মানুষ।
সকালে কর্ণফুলী নদীতে নোঙর করা নৌযানের জেলে ও বিভিন্ন ঘাটে মালামাল উঠা-নামার কাজে যুক্ত থাকা শ্রমিকেরা প্রথমে মাছ ভেসে আসার বিষয়টি দেখতে পান। এরপর দুই পাড়ের বাসিন্দারা নেমে পড়েন মাছ ধরতে। সরেজমিনে সকালে নদী তীরের শহরপ্রান্তে নতুন ফিশারিঘাট থেকে মাঝিরঘাটের বাংলা বাজার পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সী কয়েক শতাধিক মানুষ ছোট মাছ ধরছে। ব্রিজঘাটে ১০ জন শিশু মাছ খুঁজছে তীরে নেমে। দুর্বল হয়ে পড়া জীবিত মাছ ধরে ব্যাগে নিচ্ছে শিশু ও বিভিন্ন বয়সী মানুষ। হাঁটু কাদা মাড়িয়ে খালি হাতে তুলছে চিংড়ি, কাঁকড়া, টেংরা এবং বাইন মাছ।
ফিশারিঘাটের আগে টেকপাড়ার বিপরীতে নদীর পাড়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সী মানুষ ভেসে থাকা চিংড়ি ও কাঁকড়া ধরছে। টানা জাল এবং বড় জাল দিয়েও গুলশা মাছ তুলতে দেখা গেছে। তবে সকালে চিংড়ি এবং টেংরা মাছ পাওয়া গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু কাঁকড়া ও চিংড়ির আধিক্য দেখা যায়।
কর্ণফুলী নদীতে বড় আকারের মাছ বেশ আগেই বিলুপ্ত। দূষণ ও দখলে বিপর্যস্ত কর্ণফুলীতে প্রতিদিনই দুইপাড়ের শিল্প-কারখানা বর্জ্য ফেলে নদীর সত্তাকেই বিলীন করা হচ্ছে। তারপর এস আলমের গোডাউনের পোড়া চিনির রাসায়নিকে এখন নিঃশেষ হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নদীরক্ষা কমিশনের জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী দূষণের সবচেয়ে বেশি হটস্পট নগরীর শিল্পজোন এলাকা ও জেলার কর্ণফুলী উপজেলা। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা এ এলাকায়।
চিনি, সিমেন্ট, পোশাক, সার উৎপাদনকারী শিল্প, তেল পরিশোধন কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় কর্ণফুলী নদীতে। এ ছাড়াও সিটি করপোরেশন এলাকায় গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং কারখানার বর্জ্যও ফেলা হয় নদীতে। শিল্প- কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্যে এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য আগে থেকেই যেখানে ঝুঁকির মধ্যে, সেখানে এস আলম সুগারে অগ্নিকা-ে ছোট প্রজাতির যে কয়েক ধরনের মাছ ও জলজ প্রাণী রয়েছে সেসবও হারিয়ে যাবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছোট ছোট যেসব মাছ কর্ণফুলীতে বিচরণ করে সেগুলো ভাসতে দেখা গেছে। অক্সিজেন স্বল্পতায় অনেক মাছ সেন্সলেস হয়ে ভাসছে। কিছু মাছ কাদায় আটকে গেছে। সেগুলো কিন্তু মরেনি। আবার কিছু মরেছে। নদী পাড়ের মানুষ মূলত সেসব মাছই ধরছে। এখন নদীর পানির মান পুরোটাই জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করছে। জোয়ার এলে পানির মান কিছুটা ভালো হতেও পারে।
এদিকে চট্টগ্রামের পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত কয়েকটি সংগঠন গত এক সপ্তাহ যাবৎ কর্ণফুলী রক্ষার আন্দোলন করলেও গত দুদিন ধরে তাদের উপস্থিতি নেই। এসব নিয়েও চলছে সমালোচনা। শিল্প গোষ্ঠীর বিপক্ষে জোরালো আন্দোলন কিংবা বিবৃতি নেই সেসব সংগঠনের। এ নিয়ে নদীর পাড়ের মানুষ প্রচ- ক্ষুব্ধ। কর্ণফুলীর ওপর জীবিকা নির্বাহ করা অসংখ্য মানুষ গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে জানিয়েছেন তাদের কথা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরীক্ষাগারের চিফ কেমিস্ট জানিয়েছেন, তারা পানির নমুনা মঙ্গলবার সংগ্রহ করেছেন। তা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে গেছে। যেখানে নদীর পানির মানমাত্রা পাঁচ থাকার কথা সেটা কমে মঙ্গলবার ছিল এক। চিনি পুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়েছে, সেসব পোড়া অংশ পানিতে এসে পড়ায় পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে।