গাজী মনসুর
পত্রিকায় খবর পড়ছিলাম, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবারের দুর্গাপূজায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা জানানোর সময় নানা অসাম্প্রদায়িকতার গল্প বলছেন। একসময় তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে মানুষ সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম সবাই এক সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে এবং দেশ স্বাধীন করেছে। বিএনপির লক্ষ্য কোন ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, কোনো সম্প্রদায় নয়, দেশের মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নির্মাণ করা।
একটি দলের মহাসচিব কী বলেন, শেষ পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছে ছিল। তাই তাঁর আগের কথাগুলো তাদের কাজের সঙ্গে সাংর্ঘাষিক মনে হলেও হজম করছিলাম। কিন্তু তিনি যখন বললেন, বিএনপি সবসময়ই অন্যান্য ধর্মের যে অধিকার সেটা রক্ষা করার চেষ্টা করে। এর পর আর নিতে পারলাম না। পত্রিকা বন্ধ করে ইতিহাসমুখী হলাম। কারণ ইতিহাস বলছে, দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন, খুন, ধর্ষণ ও দেশত্যাগে বাধ্য করতে দলীয় ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারে সমৃদ্ধ বিএনপি।
পাঠক আসেন, একটু স্মৃতিচারণ করি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেই। শুরুতে কয়েকটি পত্রিকার শিরনাম দেখি।
১৭ অক্টোবর, ২০০১: দৈনিক জনকন্ঠ: হিংস্র শ্বাপদের জনপদ; বাগেরহাটের গ্রামগুলোতে এবার উৎসবের আমেজ নেই,পূজার প্রস্তুতিও নেই
১৭ অক্টোবর,২০০১: দৈনিক সংবাদ: লক্ষীপুর উপজেলায় অধিকাংশ মন্দিরে দুর্গাপূজা হবে না এবার
১৮ অক্টোবর, ২০০১: প্রথম আলো: বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, প্রতিমা ভাংচুর, প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল
১৯ অক্টোবর, ২০০১: প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ঘটনা অস্বীকার করার জন্য প্রশাসন ও রাজনৈতিক চাপ
১৯ অক্টোবর, ২০০১ : দৈনিক জনকন্ঠ: চট্টগ্রামে পূজা হবে অনাড়ম্বর,অনশনের ঘোষণা
২০ অক্টোবর, ২০০১ : ভোরের কাগজ: সাকা চৌধুরীর নির্দেশ,রাউজানে হিন্দু বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ,ব্যবসায়ীকে হুমকি
২২ অক্টোবর ২০০১: ডেইলি স্টার: ভারতে পালিয়ে আসা হিন্দুরা নির্যাতনের কথা বললেন
গণমাধ্যমের এই শিরনামগুলো এমনি এমনি আসেনি। ওই সময় বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে সংঘবদ্ধভাবে হামলা, নির্যাতন, লুটতরাজে নিঃস্ব হয় এদেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গঠিত তদন্ত কমিশনে পাঁচ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পায়। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া অভিযোগের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৬২৫টি। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ড ৩৫৫টি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, গুরুতর আঘাত, চিরতরে পঙ্গু করা, সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ তিন হাজার ২৭০টি। তদন্ত করা তিন হাজার ৬২৫টি ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত বলে চিহ্নিত হয়।
২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় যেসব মানুষ হামলা, লুটপাট, গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তারা থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের পর্যন্ত করতে পারেননি। কেউ অভিযোগ করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে তদন্ত হয়নি। রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন-সন্ত্রাস চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সন্ত্রাসীরা। জোট সরকারের আমলে হামলা-সন্ত্রাস লুটতরাজসহ হত্যাকাণ্ডগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ে পাঁচ হাজার ৮৯০টি মামলা প্রত্যাহারও করা হয়। যে কারণে এসব মামলার ১২ হাজার অপরাধী শাস্তি ছাড়াই বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়।
যে মহাসচিব এক সময় জামাতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল সাথে নিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, তিনি যদি এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান এবং অসাম্প্রদায়িকতার গল্প বলেন তাহলে বেখাপ্পা লাগে বৈ কী। কারণ বেশি দিনতো হয়নি। এই মাত্র ১৬/১৮ বছর আগের গল্প। তার সরকার ও দলীয় নেতা-কর্মীরা যে তাণ্ডব করেছিল তা তিনি ভুলে যাবেন এমন মনভুলো তাকে ভাবতে চাই না। তিনি ভুলে যাওয়ার ভান করছেন এমনটা বলাই বোধ হয় ভালো।
‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। কোটেশানটি সাধারণত আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবহার করেন। এবার দেখলাম ঢাকেশ্বরীর মন্দিরের বক্তৃতায় ব্যবহার করছেন মির্জা ফখরুল। সঙ্গে যুক্ত করলেন, আমরা বিশ্বাস করি, উৎসব যেমন সবার এবং রাষ্ট্রও তেমনি সবার। বাংলাদেশে কোন সংখ্যালঘু আছে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে না।
আহা কী মধুবর্ষী বক্তৃতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ফখরুল সাহেব কী এই বক্তব্য কী শুধু দেয়ার জন্যে দিলেন, না তিনি তা বিশ্বাস করেন? কারণ বাস্তবতা হচ্ছে, একই সাথে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে একদল নাগরিককে অত্যাচার আর নির্যাতন করতে করতে সংখ্যালঘু পরিচয়ে তাদের চিহ্নিত হতে বাধ্য করেছে বিএনপি। এখন বিএনপি মহাসচিবের মুখে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই বলাটা খুবই স্ববিরোধী। তিনি তার দলের নেতা কর্মীরাই অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না, তখন বলতে হয় মির্জা ফখরুলের এরকম বক্তব্য ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয় ।
ফখরুল বললেন, বিএনপি শুধু অসম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে তাই না, অন্য ধর্মের অধিকারও রক্ষা করে। ফখরুল সাহেব এটা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে, ১৯৭৭ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী এনে সংবিধান থেকে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার কথা মুছে ফেলেন তার দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। এই সংশোধনীর মাধ্যমে তার দল বিএনপি ধর্মের অধিকার রক্ষা তো অনেক দূরের ব্যাপার, ধর্মের অধিকার হরণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সংশোধনী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরর ওপর কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। আর সেই কাজটি জিয়াউর রহমান করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানপন্থীদের খুশি করতে।
ইতিহাসের আলোচনায় বিএনপির প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ যখন আসলোই, তখন এর সঙ্গে জড়িত সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গটিও আসতে পারে। যেমন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন জিয়াউর রহমান। নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তিনি সেনাবাহিনীর উর্দি খুলে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি,সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলছুট নেতাদের দিয়ে গঠন করেন বিএনপি ।
সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উৎস, জামাতকে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনঠাসা জামাতকে আবার দেশের রাজনীতিতে এনে বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাদের প্রতিষ্ঠার মধ্যেই প্রকাশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক ইসলামিক দলগুলোকে ছাড়তে পারেনি বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো যতবার সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে, বিএনপি তাদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৩ সালে যখন গণজাগরন মঞ্চ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গণজাগরন মঞ্চকে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ ই মে যখন ধর্মভিত্তিক দল হেফাজত ইসলাম মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে অবস্থান করেছিল বিএনপি তখন প্রকাশ্যে তাদের খাবার পানীয় যোগানের ঘোষণা দিয়েছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামাতকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ হরকাতুল জিহাদের মত উত্থান হওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বিএনপি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত জঙ্গিদের বয়ান থেকে জানা যায়, প্রতিটি হামলায় তারেক রহমানসহ সেসময়ের বিএনপি নেতারা জড়িত ছিল।
আজ যে দুর্গাপূজার মণ্ডপে গিয়ে ফখরুল সাহেব অসাম্প্রদায়িক বাণী শোনাচ্ছেন, ২০০১ সালের দুর্গাপূজার মণ্ডপগুলোতে তারই নেতা কর্মীরা ভয়ঙ্কর তাণ্ডব করেছিল। বিএনপি- জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার কদিন পরই শুরু হয়েছিল সেই দুর্গাপূজা। শুধু সেই অক্টোবরে সংখ্যালঘু মানুষের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন করেছিল বিএনপি-জামাতের নেতা কর্মীরা তাতে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “সংখ্যালঘু নির্মূলের এক অন্যায্য কর্মসূচির নীরব বাস্তবায়ন চলছে বাংলাদেশে “।
লেখা শেষ করবো, মির্জা ফখরুল সাহেবকে একটা প্রশ্ন করে। এত কিছুর পরেও কী তিনি বলবেন যে তার দল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়েতে চায় ?
লেখক: গণমাধম কর্মী