দৈ. কি.ডেস্ক : নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই সময়ের পর থেকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দলটি ক্ষমতায় ছিল টানা ১৫ বছর ৭ মাস। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে তিনটি। সবগুলোই ছিল ভোটারবিহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন।
এ দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতাসীন থাকা দলটির বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, সংবিধানকে সংশোধন, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের অভাব, তিনবারের বিতর্কিত নির্বাচন, ব্যাপক মাত্রায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করার ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পদক্ষেপগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথও রুদ্ধ করা হয়েছিল নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে এসবের সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে বিধি অনুযায়ী নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনে দলীয় কর্মীর মতোই ভূমিকা রেখেছেন তারা।
রাজনীতির মাঠে খলনায়কের মূখ্য ভূমিকায় ছিল জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু! জুলাই-আগস্ট তীব্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে হাসিনার দেশ পলায়নের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতির এক আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। অন্য একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও বিগত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে আওয়ামী শাসনামলে ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমপি থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত সব স্বাদই নিয়েছেন।
আলোচনা রয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচন বয়কট বা বর্জনের পথে হাঁটে, তখন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নেয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা রাখেন মুজিবুল হক চুন্নু। মহাজোটের অংশীদার হিসেবে তখন তিনি হাসিনা সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে চুন্নু তার নিজ আসন কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত ড. মিজানুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সরকারি দলের সহযোগিতায় ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে তাকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন মুজিবুল হক চুন্নু। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পুরস্কার হিসেবে মুজিবুল হক চুন্নু মন্ত্রিসভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোটের নির্বাচনেও মুজিবুল হক চুন্নুর কৌশলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের সঙ্গী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি।
মহাজোট প্রার্থী হিসেবে চুন্নু ‘লাঙ্গল’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। সে নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার স্বীকারোক্তি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে জাতীয় পার্টির সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলবো এটা হয়। এটা হয় না, ঠিক না।’
এর আগে ২০২১ সালের ৯ অক্টোবর জাতীয় পার্টির কোণ্ডচেয়ারম্যান থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব করা হয়। তাকে মহাসচিব করার ব্যাপারেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তদবির ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র বলছে, সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে মহাসচিব হিসেবে প্রায় একক সিদ্ধান্তে চুন্নু জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়ে যান। এমনকি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় মুজিবুল হক চুন্নু তার নির্বাচনী পোস্টারে নিজেকে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেন। সে সময় চুন্নু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়।
এদিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শুরুর দিকে বেশ স্বস্তিতেই সময় পার করেন মুজিবুল হক চুন্নু। ৫ আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক এবং ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলে জাপা মহাসচিব চুন্নু থাকলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরোধিতার মুখে পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি। এতে জাতীয় পার্টির পাশাপাশি দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিপাকে পড়েন। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় মুজিবুল হক চুন্নুকে আসামি করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিকে ঘিরে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর আজমপুর এলাকায় গুলিতে নিহত আলমগীর হোসেন (৩৪)-এর মা মোসা. আলেয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। সাবেক ফ্যাসিবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে করা এ মামলায় ৬নং আসামি করা হয়েছে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এটি মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম ও একমাত্র মামলা। এরপর থেকেই নেপথ্যে চলে যায় মুজিবুল হক চুন্নু। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি তার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে জানাজানি হওয়ার পর সেখানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নিজ এলাকার মানুষ মুজিবুল হক চুন্নুকে এ মামলায় অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।
দ্বিতীয় মামলাটি হয় ২৩ অক্টোবর করিমগঞ্জ থানায় মামলাটি করেছেন কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ওমর কাইয়ুম। এ পরিস্থিতি আসলে চুন্নু কীভাবে সামাল দিবেন, সেটিই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় ফোরামে চুন্নু যাই বলেন না কেন, আওয়ামী লীগকে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল জাতীয় পার্টি এবং এক্ষেত্রে মূল কারিগরের ভূমিকায় ছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু।
শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও জনমনের আশা আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করে বিনা ভোটের নির্বাচনে বারবার অংশগ্রহণ করে শেখ হাসিনার দানবিক রাষ্ট্র পরিচালনায় সহযোগিতা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার সেরা নজির সৃষ্টি করেছেন জাপার মহাসচিব, কিশোরগঞ্জ-৩ (তাড়াইল-করিমগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।
‘শুধু ক্ষমতার কারণেই এগিয়ে ছিল জাতীয় পার্টি। এখন সেই সময় আর নেই। দলটি একমাত্র মুজিবুল হক চুন্নুর কারণে নীতি-আদর্শে না থেকে সুবিধাবাদী নতজানু রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই আজ চরম সংকটে বলে মনে হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন বিশেষ করে চুন্নুর বিরুদ্ধে বেশি সরব আলোচনা চলছে। চুন্নুর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলায় গ্রেফতার হবেন কি-না? সেটি নিয়েও জনমনে রয়েছে নানান গুঞ্জন।
এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী শাসনের (২০০৯-২০২৪) দানবিক রাষ্ট্রের কারিগর বাংলার আকাশ ঘোলাটে করার নেপথ্যের খলনায়ক এই বাংলার ভূমিতে আবির্ভূত নতুন মিরজাফর নামে খ্যাত জাপার মহসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গ্রেফতার হবেন নাকি পুনর্বাসিত হবেন!