বিশেষ প্রতিবেদক
একবিংশ শতাব্দিতে বাংলাদেশে এক অসাধারণ রূপান্তর চলছে। যারফলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক উদীয়মান তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় গোটা বিশ্ব যখন অন্ধকার সময় পার করছিল তখনও বাংলাদেশ আশার আলো দেখাচ্ছিল। মহামারী দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি থামাতে পারেনি। অনেক দেশ যখন হোঁচট খাচ্ছিল, অর্থনীতি ধ্বসে পড়ছিল, বাংলাদেশ তখন ভালোভাবে সেই ঝড় মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন টাইম ইন্টারন্যাশনালের চলতি অক্টোবর সংখ্যায় এভাবেই বাংলাদেশকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন করেছে।
প্রতিবেদনে তারা বলছে, বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, একাধিকবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতাকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল এবং দেশটির উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনার অভাব ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে চলছে এক অসাধারণ রূপান্তর। দেশটি এখন আবির্ভূত হয়েছে অর্থনৈতিক উদীয়মান তারকা হিসাবে।
লন্ডন ভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি রিপোর্টের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত উর্ধমুখী। বিশ্বে দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সেরা।
২০২১ সালে মহামারীর সর্বোচ্চ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে ৬.৯%। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবৃদ্ধি যে চিত্তাকর্ষক ও টেকসই হতে পারে বাংলাদেশ তা প্রমাণ করছে। বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, বাংলাদেশে ভবিষ্যত উজ্জ্বল। দেশটির অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়ে আজ বিশ্বের ৩৪তম বৃহত্তম থেকে ২০৩০ সালে ২৮তম এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫তম একটি ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে এটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
একবারে "তলা বিহীন ঝুড়ি” থেকে কীভাবে দেশটির এমন চমকপ্রদ পরিবর্তন হয়েছে তার গল্প তুলে ধরে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-গল্পটি হল বাংলাদেশ দৃঢ় সংকল্প। সদিচ্ছা।
সরকারের বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত ও বর্ধিত করা এবং বিনিয়োগ, ব্যবসা-বান্ধব নীতি ও পরিবেশ তৈরি করা অন্যতম। ১০০টিরও বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে এগুলোতে উৎপাদনের পরিবেশ তৈরির জন্য বিশেষায়িত নির্দিষ্ট শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য আকর্ষণীয় প্রণোদনা দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে এগুলো রপ্তানিমুখী অর্থনৈতিক কৌশলকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশের রপ্তানি শিল্পগুলি কৌশলগতভাবে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের ব্যস্ত শিপিং লেনে অবস্থান করার পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষি-ভিত্তিক রপ্তানি এখন শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, চাল ও সবজির তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এবং স্বাদুপানির অভ্যন্তরীণ মাছের জন্য চতুর্থ বৃহত্তম।
পরিসংখ্যানগুলি দেখলে হয়তো কেউ কেউ অনুমান করতে পারে যে বাংলাদেশ প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে আছে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। এখন বিদেশী এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালস, চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, জাহাজ নির্মাণ এবং ইলেকট্রনিক্সের অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের রপ্তানির ম্যানুকে বৈচিত্র্যময় করছে এবং আরও অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করছে। এসবের মধ্য দিয়ে দেশ বদলে যাচ্ছে, পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত হতে চলেছে।
এই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৪৫% এরও বেশি বাংলাদেশীর বয়স ২৪ বছর বা তার কম, যেখানে ৭০% জনসংখ্যা ৪০ বছর বা তার কম বয়সী। তারুণ্য এবং প্রবীণদের প্রাণশক্তির যুথবদ্ধতা ইতিমধ্যেই নতুন এবং কর্মউদ্দীপনা পূর্ণতা তৈরি করছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল ভোক্তা বাজার হিসেবে গড়ে তুলছে। এইচএসবিসি’র তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটি পূর্বাভাস দিচ্ছে যে, দেশের ভোক্তা বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৭% বৃদ্ধি পাবে, এটি জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে বিশ্বের নবম বৃহত্তম হবে ৷ স্পষ্টতই, এটি বাংলাদেশকে পণ্য তৈরি ও বিক্রির জন্য একটি লোভনীয় জায়গা করে দিচ্ছে।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিটাল অর্থনীতি খাতে তরুণরা বড় পরিবর্তন আনছে, যা এখন দেশের প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সর্বোচ্চ সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী অনলাইন কর্মশক্তিতে জনগণের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ২৮টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং আইটি প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল জ্ঞান ও উদ্ভাবন ভাইরাল হচ্ছে।
ডিজিটাল অবকাঠামো প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্যগত অবকাঠামোরও ব্যাপকভাবে উন্নতি হচ্ছে।পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর, পানির নিচে টানেল নির্মাণ হয়েছে আরও অনেক মেগা প্রকল্প নির্মাণাধীন বা সমাপ্তির পর্যায়ে রয়েছে। এরমধ্যে একমাত্র মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরই জিডিপি ১.১৪% বৃদ্ধি করবে। ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৪০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু ঢাকাকে স্বল্পোন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করায়- আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল- যার ধারণক্ষমতা ২৪ মিলিয়ন যাত্রী। ধারনা করা হচ্ছে এই টার্মিনালে প্রতি বছর ৫০০০০০ টন কার্গো রাজধানী ঢাকাকে এই অঞ্চলের জন্য একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে করে তুলবে।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনটি শেষ করা হয়েছে এই বলে যে, বাংলাদেশ যখন নতুন যুগে প্রবেশ করছে, তখন কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না যে আমাদের বিশ্বের জন্য সামনে কী রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মহামারী সম্পর্কে খুব কমই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিলো। কিন্তু এই শতাব্দীতে বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় এবং স্থিতিস্থাপক অর্থনীতি গড়ে তুলতে সফল হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে, এমনকি উন্নতি করতে সক্ষম হবে। প্রতিশ্রুতি এবং সম্ভাবনার সাথে, বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি শক্তি হিসাবে উপস্থিত থাকবে এবং এর তারা জ্বলতে থাকবে।