প্রফেসর ড. স্বপন চন্দ্র মজুমদার
সুনীল অর্থনীতি হলো গভীর সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। গভীর সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং সমুদ্র তলদেশের বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে ব্লু-ইকোনোমি। বাংলাদেশের জন্য ব্লু-ইকোনোমি হতে পারে অপার সম্ভাবনা। সুনীল অর্থনীতি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, উন্নত জীবিকা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের জন্য সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার বোঝায়। এটি মৎস্য, জলজ, সামুদ্রিক পরিবহন, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং পর্যটনসহ বিস্তৃত ক্রিয়াকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর বরাবর একটি বিস্তীর্ণ উপকূলরেখার দেশ, সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে অপরিসীম ভুমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বে গুরুত্ব পায় বঙ্গোপসাগর। এটি বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী জলপথে চলাচলকারী গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক করিডোরের অন্যতম প্রধান চ্যানেল। বিশ্বের কনটেইনার পরিবহনের অর্ধেক এবং বিশ্ব বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ সংগঠিত হয় এ সমুদ্র দিয়ে। বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ হয় এ সমুদ্রপথে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা তেল ও গ্যাসের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যথাক্রমে ২০১২ ও ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়। এর মাধ্যমে সমুদ্রে বাংলাদেশ অর্জন করে নিজের মূল ভূখণ্ডের ৮১ শতাংশ পরিমাণ জলসীমা। বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার জলরাশিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার। আগে থেকে সাথে আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্রগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপানের তলদেশে সবধরনের প্রাণীজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার।
এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমুদ্রের নিচে রয়েছে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুত। এরই মধ্যে মিয়ানমারের আরাকান উপকূলীয় এলাকায় বড় বড় অনেক গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশ অংশেও রয়েছে এর সম্ভাবনা। গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের সুবিশাল জলরাশির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতির এক অপার সম্ভাবনা।
দেশের এ সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ব্লু-ইকোনোমি খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে নটি খাতে সুনির্দিষ্ট করে কাজ চালাচ্ছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় দুবছর গবেষণার পর গতবছর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত সমুদ্র এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির বেশকিছু মূল্যবান উদ্ভিজ এবং প্রাণিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুরো এ গবেষণায় যুক্ত ছিলো যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড বা শ্যাওলা, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস রয়েছে।
সুনীল অর্থনীতির সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য নিচের বিষয়গুলুর প্রতি সুদৃষ্টি দরকার।
মৎস্য ও জলজ চাষ
বাংলাদেশের মৎস্য ও জলজ চাষের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, যা আমাদের জনসংখ্যার জন্য আয় ও পুষ্টির একটি উল্লেখযোগ্য উৎস দেয়। আধুনিক এবং টেকসই মাছ ধরার অনুশীলনে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা সামুদ্রিক সম্পদের দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারি। প্রযুক্তি-চালিত সমাধানগুলি বাস্তবায়ন করা, যেমন মাছ ধরার জাহাজের জন্য জিপিএস ট্র্যাকিং এবং উন্নত জলজ চাষ কৌশল, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করার সময় উৎপাদন বাড়তে পারে।
সামুদ্রিক পরিবহন এবং সংযোগ
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এটিকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার করে তোলে। বন্দর এবং শিপিং সুবিধার মতো সামুদ্রিক পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। দক্ষ শিপিং রুট এবং লজিস্টিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই বাড়াবে না, এই অঞ্চলে বাংলাদেশকে একটি সামুদ্রিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করবে।
সমুদ্র থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি
টেকসই শক্তির উৎস হিসেবে ব্লু ইকোনমির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ তার শক্তির মিশ্রণে বৈচিত্র্য আনতে জোয়ার ও তরঙ্গ শক্তির পাশাপাশি অফশোর উইন্ড ফার্মের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে। সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ শুধু ঐতিহ্যগত শক্তির উৎসের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করবে না বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় অবদান রাখবে।
পর্যটন এবং নীল স্থান
বাংলাদেশের প্রচলিত উপকূলীয় অঞ্চল এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য অনন্য এবং টেকসই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশ বান্ধব পর্যটন অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং দায়িত্বশীল পর্যটন অনুশীলনের প্রচার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। উপরন্তু, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জীবনজাত্রায় সামগ্রিক স্থিতিস্থাপকতায় অবদান রাখবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
যদিও ব্লু-ইকোনমির অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত মাছ ধরা, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই ব্যবস্থাপনা অনুশীলন, উন্নত প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা সমর্থিত, সামুদ্রিক সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশ যখন ২০৪১ সালে একটি স্মার্ট দেশ হওয়ার দিকে তার যাত্রা কল্পনা করছে, তখন ব্লু ইকোনমি টেকসই উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর সামুদ্রিক সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে, দেশটি কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই অর্জন করতে পারে না বরং এর উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মঙ্গল ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পারে। একটি স্মার্ট বাংলাদেশের পথ সুনীল অর্থনীতির তরঙ্গের মধ্যে নিহিত, যা সমৃদ্ধির দিকে এটির যাত্রা শুরু করেছে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।