পলাশ আহসান
একজন নয় দু’জন নয় ২জন সাংবাদিক বিএনপি কর্মীদের হামলায় আহত! অবাক না হয়ে উপায় কী? একজন দু’জন হলে না হয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যেতো। কিন্ত সংখ্যাটা যখন এত বেশি তখন বলতেই হবে সাংবাদিকদের ওপর বিশেষ ক্ষোভ রয়েছে বিএনপি কর্মীদের। শুধু তাই নয়, বলতে হবে এই হামলা পরিকল্পিত এবং নির্দেশিত। কিন্তু কেন? সাংবাদিকদের সঙ্গে তো রাজনৈতিকে কর্মীদের শত্রুতা থাকার কথা নয় বরং বন্ধুত্ব থাকার কথা। যুগে যুগে তাই ছিল। কিন্তু কেন জানি, এই ২৮শে অক্টোবরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০ এর গণঅভ্যূত্থানের ধারাবাহিকতা ভাঙলো।
আমাদের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, কোন রাজনৈতিক দল যেটা করবে সাংবাদিক সেটা প্রচার করবে। সারাদেশের মানুষ তাদের মাধ্যমেই কী হয়েছে সেটার একটা চিত্র পাবে এবং তার এই মুহূর্তের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ২৮শে অক্টোবর আমরা কী দেখলাম? দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে একের পর এক সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হলো। মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হলো। টেলিভিশনের গাড়ি ভাঙা হলো। অদ্ভুদ। আগে কখনো এরকম দেখেছি বা শুনেছি বলে আমি মনে করতে পারছি না।
একদল লোক যাদের কাজ তথ্য সংগ্রহ করা এবং ছবি তোলা। তারা নানা ঘটনার ছবি তোলে এবং তথ্য সংগ্রহ করে। পরে এই ছবি এবং তথ্য মিলিয়ে মানুষকে খবর জানায়। তাহলে কী এখন আমরা বলবো গণমাধ্যমকে বিএনপির দরকার নেই? আমার মনে হয়, সেটা বলার যায়। কারণ আমরা জানি, গত দুই মাস ধরে বিএনপি দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা দেশের অন্যতম দুটি টেলিভিশনে যাবে না এবং কথা বলবে না।
দুই টেলিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার সিদ্ধান্তটা অবশ্য প্রকাশ্য। গণমাধ্যমের প্রতি কোন রাজনৈতিক দলের এমন প্রকাশ্য বিদ্বেষ অবশ্য বিরল। কিন্তু কাজটি তারা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় চিন্তা করলে বলা যায়, সাংবাদিকদের প্রতি বিএনপি কর্তৃপক্ষের বিদ্বেষ রয়েছে। আরও বলা যায় এই বিদ্বেষ সদ্য নয়। বেশ পুরোনো। না হলে একদিনেই ২৭ জন সাংবাদিকের ওপর হামলার সিদ্ধন্ত নেয়া যায় না।
আমি আহত কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বেশিরভাগই ফটো সাংবাদিক। তারা প্রত্যেকেই কাজ করছিলেন। অর্থাৎ এই হামলা মাঠে কর্মরত সাংবাদিকের ওপর হামলা। যারা হামলা শিকার হয়েছেন, তারা নিজের পরিচয় লুকাননি। যে কারণে বিএনপি কর্মীদের হামলার জন্যে তাদের খুঁজে বের করতে দেরি হয়নি। পরে কেউ কেউ অবশ্য পরিচয় লুকিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন।
২৮শে অক্টোবর নিশ্চয়ই সাংবাদিকরা বার্তা পেয়ে গেছেন যে, এখন থেকে বিএনপির খবর সংগ্রহ করতে হলে সাবধানে করতে হবে। সেই সাবধানতা বিএনপির জন্যে কতটুকু ভালো হবে, আমি জানি না। কিন্তু সাংবাদিকদের অনেকেই বিএনপির কর্মসূচির্ খবর সংগ্রহ করার ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, এটা এখন স্বাভাবিক। এই সরল সত্য বোঝার ক্ষমতা বিএনপি নেতাদের নেই, সেটা ভাবতে চাই না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিএনপি প্রচলিত গণমাধ্যমকে এমন বার্তা দিল? তারাতো একটি রাজনৈতিক দল। নিজেদের কথা তো বলতেই হবে। তাহলে মাধ্যমটি কী হবে? এখনতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া, আমি কোন মাধ্যম দেখছি না। তারা যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর হয়ে পড়েছে, সে নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থাকার কথা নয়। সেকথা পাঠক্ও নিশ্চই জানেন। কিন্ত প্রচলিত গণমাধ্যম ফেলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর কতটা ঠিক হলো?
চরিত্র অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে যা খুশি তাই বলা যায়। কিন্তু একজন গণমাধ্যম কর্মী কখনই যা খুশি তা বলতে পারেন না। কিছু বলতে হলে তাকে নানা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বলতে হয়। তার ক্লু লাগে সোর্স লাগে। নিশ্চিত হওয়ার দরকার পড়ে। তাই একজন সাংবাদিক যেটা বলেন সেটার ওপর মানুষ ভর করতে পারেন। কিন্তু সত্যের জন্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধমের ওপর ভরে করলে সেই ফল যে খুব ভালো হওয়ার কথা নয়, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
সা্ংবাদিক তার কাজের পদ্ধতির কারণে হয়তো বিএনপিকে খুশি করতে পারছে না। যেকারণে তারা আজ প্রচলিত গণমাধ্যম বিমুখ। এখন বিএনপির এই প্রচলিত গণমাধ্যম বিমুখতার সূত্র ধরে কেউ যদি বলে, এই মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধেমে সরকার বিরোধী যত প্রপাগাণ্ডা এসবই বিএনপির পরিকল্পিত তিনি কী ভুল বলবেন? কেউ যদি বলেন সাংবাদিকদের হামলার পরিকল্পনা এবং সরকার বিরোধী প্রপাগাণ্ডার পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা, তিনিও কী ভুল বলবেন?
তাদের কথা ভুল না ঠিক সেটা আমার মূল আলোচনা নয়। মূল কথা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ভর করে বৈতরনী পার হওয়া যাবে না। কারণ তারা একটি রাজনৈতিক দল। সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলে তাদের জন্ম। কিন্তু আমাদের এখনকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভরকেন্দ্র হচ্ছে ঘৃণা। এই ঘৃণা দিয়ে আর যাই হোক, মানুষের কল্যাণ করা যায় না।
এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম, শনিবারের সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগ এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ প্রতিটি সহিংসতা পর্যালোচনা করা হবে। সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য এই সহিংসতা আমলে আসবে। আপাতত আর কিছু বলতে চাই না। শুধু বলি, মাথাভরা ঘৃণা থাকার ফল যে ভাল কিছু আনে না, তা প্রমাণের জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।