নিজস্ব প্রতিবেদক
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। তার এই অর্জনকে এক কন্যার উত্থান হিসেবে আখ্যা করেছে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু। ‘ রাইজ অব দ্য ডটার’ শিরোনামে ওই নিবন্ধ ছাপা হয়। ভারতীয় সাংবাদিক অরুণ দেবনাথ নিবন্ধটি লিখেছেন।
নিবন্ধে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যাকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মিডিয়ার তীব্র আকর্ষণ, সমালোচনা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগের পরে তার জয় এসেছে। বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া সায়মা ওয়াজেদ এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন।
তিনি বাংলাদেশের প্রতিবেশী নেপালের প্রস্তাবিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শম্ভু প্রসাদ আচার্যের বিপক্ষে ১০ ভোটের মধ্যে আটটি ভোট পেয়েছেন। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণকারী প্রথম নারী হিসেবে ভারতীয় নাগরিক পুনম ক্ষেত্রপাল সিংয়ের স্থলাভিষিক্ত হবেন ওয়াজেদ। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো ক্ষেত্রপাল সিংকে দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত করেছিল।
গত ১ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে এক রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে সদস্য দেশগুলো সায়মা ওয়াজেদকে মনোনীত করার পক্ষে ভোট দেয়। আগামী জানুয়ারিতে জেনেভায় অনুষ্ঠেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী বোর্ডের ১৫৪তম অধিবেশনে এই মনোনয়ন জমা দেওয়া হবে। নবনিযুক্ত আঞ্চলিক পরিচালক আগামী ১ ফেব্রুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।
সায়মা ওয়াজেদকে মনোনয়ন দেওয়ার বাংলাদেশের এই প্রস্তাব প্রকাশ্যে আসার পর তার মা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় কিছু গণমাধ্যম স্বজনপ্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু ওয়াজেদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এই সমালোচনাগুলো তার পেশাগত পরিচয়কে উপেক্ষা করেছে। গণমাধ্যমের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা এবং আমাকে কেবল আমার মায়ের মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করা এক ধরনের বৈষম্য। ’
সায়মা ওয়াজেদ এই ধারণারও বিরোধিতা করেন যে, তিনি সবসময় একটি সুবিধাজনক জীবন যাপন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি হিসেবে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করলেও তিনি তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘আমার প্রথম স্মৃতি ছিল শরণার্থী হিসেবে ভারতে বেড়ে ওঠার স্মৃতি। তিনি আরও বলেন, ‘ট্রমা, গোপনীয়তা, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি এবং সবসময় সচেতন থাকা আমি, অন্য সবার মতো নই, এটি আমার কাছে দ্বিতীয় স্বভাব ছিল।
সায়মা ওয়াজেদ নিজেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, তিনি ছোটবেলায় প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের সাথে সাবলীলভাবে হিন্দি বলতেন, বাড়িতে বাংলা বলতেন এবং স্কুলে ইংরেজি শিখেছিলেন। অন্যদের সঙ্গে দীপাবলি ও হোলি উদযাপন করা এবং আমার মাকে নামাজ পড়তে দেখা আমাদের জন্য নিত্যদিনের বিষয় ছিল।
তার তরুণ জীবনের সময়গুলো ফ্লোরিডায় কেটেছিল। তিনি শিখছিলেন এবং কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ইউরোপীয়, এশিয়ান, ক্যারিবিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকার সংস্কৃতির একটি মিশ্রণ যা পারিবারিক গতিশীলতা, ধর্মীয় এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং অনুশীলন সম্পর্কে আমার জ্ঞানকে প্রসারিত করেছিল।
নিবন্ধে বলা হয়, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তার মায়ের নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি স্বাস্থ্য খাতে এডভোকেসি ও পলিসি ডেভেলপমেন্টে কাজ করেছেন। এটি তাকে স্বাস্থ্য খাতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো আরও ভালভাবে বুঝতে সক্ষম করেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচনের আগে তিনি সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ তার মায়ের সাথে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আগস্টে জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচন তার প্রার্থিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তীব্র মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং এই ভূমিকার জন্য তার যোগ্যতা সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করেছে। জবাবে ওয়াজেদ দাবি করেন, ওই সব নিবন্ধের যুক্তিগুলো ‘ক্ষতিকর পক্ষপাতিত্বের’ উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে এবং ‘ক্ষতিকর স্টেরিওটাইপস’কে স্থায়ী করা হয়েছে।
ওয়াজেদ জানিয়েছেন, ‘যদিও আমি স্বীকার করছি যে আমার মায়ের অবস্থানের কারণে আমার আরও বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল আমার বছরের পর বছর ধরে কাজ, অধ্যয়ন এবং অর্জনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া।’
তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পাবলিক ডোমেইনে থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধগুলো চ্যাথাম হাউসের গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রাম বা এর কমিশন ফর ইউনিভার্সাল হেলথের সঙ্গে তার কাজের কথা উল্লেখ করেনি। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মানসিক স্বাস্থ্য এবং অটিজম সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের উপদেষ্টা ছিলেন বা তিনি প্রায় এক দশক ধরে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ছিলেন। এখন যেহেতু ঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে, ওয়াজেদকে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো অঞ্চলের ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ’ মানুষের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তবুও তিনি বলেছেন, ‘আমি পিছু হটব না।’