নিজস্ব প্রতিবেদক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি বড় ভুল করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, ভোটে অংশ নিলে বিএনপি সরকার গঠন করতে না পারলেও, অনেক বেশি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হতে পারত। কারও কারও মতে, ভোটের ট্রেন ছেড়ে দিয়ে বিএনপি ‘ঐতিহাসিক ভুল’করেছে।
বিএনপি’র ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘিরে শুধু দলটির ভবিষ্যৎই নয়, বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতি কোন পথে এগোবে সেই প্রশ্নও এখন জনমনকে নাড়া দিচ্ছে। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই প্রধান বিরোধী পক্ষ হবে, যদি না তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে বিরোধী দল নিয়ে ভোটের আগেই আলোচনা তুঙ্গে।
রাজনীতির ধারাবাহিক পর্যবেক্ষক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ড. হারুন অর রশিদ মনে করেন, এই নির্বাচনের পর বিএনপি আসল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। দলের গণতন্ত্রকামী, নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী অংশের প্রশ্নের মুখে পড়বে নেতৃত্ব। বিক্ষুব্ধ অংশের পৃথক দল গড়াও অসম্ভব নয়। তখন আরও বড় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে খালেদা জিয়ার দল।’
তবে একই সঙ্গে অধ্যাপক রশিদ মনে করেন, ‘বিএনপি দলগতভাবে দুর্বল হলেও তাদের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা রাতারাতি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে না।’ তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি আজ বিলুপ্ত। বিএনপি তাদেরই অবতার। ওই দুই দলের মতো বিএনপি যদি মুছেও যায় তাহলেও তাদের মতাদর্শবাহী মানুষ থাকবে। হয়তো তারা ভিন্ন কোন দলে গিয়ে ভিড়বে।’
ড. রশিদের কথায়, ‘জেনালের জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং বিএনপির সরকারের সময়কে যোগ করলে এই শক্তি কম-বেশি ২৯ বছর ক্ষমতা ভোগ করেছে। বিএনপি’র দ্বারা উপকৃত মানুষ তাই এ দেশে নেহাৎ কম নয়। তাঁরা চাইবে না বিএনপি ভেঙে যাক।’ এই অবস্থায় তিনি মনে করেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিকে বাংলাদেশে বিএনপি’র বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক একটি বিরোধী দল তৈরির প্রেক্ষাপট হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই ব্যাপারে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকেই উপযুক্ত অনূকূল পদক্ষেপ করতে হবে।’
আর এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মান্নান মনে করেন, বিএনপির প্রধান সংকট দুটি। এক. আদর্শিক। দুই. সাংগঠনিক। তাঁর কথায়, ‘দলটি গঠন করেছিলেন জেনারেল জিয়া। দলের বিস্তার ঘটান তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া। আর দলটি পতনের মুখে পড়েছে তাঁদের পুত্র তারেক জিয়ার হাতে।’
তিনি বলেন, ‘জেনারেল জিয়া বিএনপি-কে বড় করতে প্রাক্তন ও কর্মরত সেনা এবং প্রশাসনিক কর্তাদের দলে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের দল ও সরকারে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত রাজনীতি কখনও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এটা বুঝতে না পারা বিএনপি’র বড় ভুল।’
ড. মান্নান আরও বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল সন্দেহ নেই। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তাঁর পুত্র দলীয় সাংগঠনিক নিয়ম ভেঙে দলের কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু লন্ডনে বসে কতদিন দল চালানো সম্ভব? স্থানীয় নেতাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিলে দলটি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারত।’
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজার কথায়, বিএনপি’র ভোট বয়কটের সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব তৈরি করবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। কারণ, আদর্শ গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকা জরুরি। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় বিরোধী পরিসর নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। সেনা শাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদের দল বিরোধী দলের তকমা নিয়ে সংসদে গেলেও তারা সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
আর এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক মনে করেন নির্বাচনের পর বিএনপি পুরোপুরি ভেঙে যাবে। কারণ লন্ডন থেকে তারেকের কথা বিএনপির নেতারাই মানেছে না। তাছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনকে এড়িয়ে যাওয়া মস্ত বড় ভুল। ভোটের ট্রেন ছেড়ে দিয়ে বিএনপি ‘ঐতিহাসিক ভুল’করেছে বলেও মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি।