গাজী মনসুর
মাত্র কদিন আগেই বিএনপি কর্মীরা যেন নিরাপদে কর্মসুচি পালন করতে পারে সেই তদবির নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সর্বকালের সব কূটনেতিক শিষ্টাচার ভাঙার এই রেকর্ডে বিস্মিত হয়েছিল মানুষ। পিটার হাসের মুখে তখন রাজনৈতিক অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষার বাণী। এরও কদিন আগে থেকে ছিলো স্যাংশনের জুজু বুড়ির গল্প। সেখানেও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে মানবাধিকার রক্ষার ইস্যুটি সামনে ছিল। সব মিলিয়ে গত দু’মাস ধরে মানবাধিকারে ওপর ভর করে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলাফল ২৮শে অক্টোবরের কাকরাইল।
এখন কেউ যদি বলেন ২৮ শে অক্টোবরে মানবাধিকার ভাঙার সুযোগ করে দিতেই এত কিছু করেছিলেন হাস সাহেব। তিনি কী ভুল বলবেন? নিশ্চয়ই নয়। কারণ প্রকাশ্যেই আমরা হাসের যত পক্ষপাতদুষ্টের নমুনা দেখেছি, এরকম তাণ্ডব করার সাহস পাওয়ার জন্যে এটা যথেষ্ট। আমার তো মনে হয় সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তদবির নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুধু তদবিরের জন্যে ছিল না। বিএনপির যে কর্মীরা ঢাকায় আসছে এটা তদের জন্যে ছিল হাসের পরিস্কার বার্তা। সেটা অনেকটা এরকম “ তোমরা আসো, যা ইচ্ছে করো। আমি হাস তোমাদের পেছনে আছি”
বার্তা পেয়ে একান্ত বাধ্য অনুগত বিএনপি কর্মীরা সেই কাজটি করেছে। ২৭শে অক্টোবর রাত থেকে নয়াপল্টনে জমায়েত হওয়া। তার সারাদিন অফিসের সামনে সমাবেশ করা। শেষ হওয়ার একটু আগে সহিংস হয়ে ওঠা। এই তো। পিটার হাস যাদের দায়িত্ব নিয়ে মানবাধিকার রক্ষার সমাবেশের তদবির করেছিরেন তারা মানুষ পুড়িয়ে মারলো। পুলিশ টিপটিয়ে হত্যা করলো। হাসপাতালে আগুন দিল। বেছে বেছে সাংবাদিক ধরে পেটালো। রাতে হাস সাহেব ও তার দেশে একখানা নিন্দা জানিয়ে শেষ করলেন তাদের নিখুঁত পরিবেশনা।
আপাতত মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব পিটার হাস ও মার্কিন দূতাবাস এই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু নিয়ে আর কোন টুঁ শব্দ করছেন না। এখন এই মানবাধিকার হরণকারীদের কে দমন করতে যাবে? কে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনে পড়ার ঝুকিঁ নেবে? আমরা আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে ভুল করি। আজ যে বিএনপি নেতা কর্মীরা হাসের কথায় মাঠে নেমেছেন তারাও ভুল করেছেন। কারণ তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে গল্পটি মানবাধিকার নয়, আধিপত্য বিস্তারের।
অথচ মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র রয়েছে রীতিমতো। ঘোষণাপত্রের প্রথম ধারায় আছে, প্রত্যেক মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার আছে। দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, সকল ব্যক্তি আইনের সামনে সমান। এই ঘোষণাপত্রে মোট ১৮ টি ধারা আছে। জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের অধিকার ও কর্তব্য এই ঘোষণাপত্রে প্রতিষ্ঠিত । সেই হিসাবে গতকাল যে পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরও তো এই অধিকার আছে। তাহলে তাঁর ব্যাপারে কেন এই নীরবতা?
অথচ বাংলাদেশে আমরা দেখলাম মানবাধিকারের প্রশ্নে পিটার হাস একচোখা। কারণ মুখে মুখে মানবাধিকার রক্ষার দায়ভার অনেকদিন ধরেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্ত কাজের বেলায় এসে আমরা দেখলাম ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতা। অথচ শাপলা চত্বরে নিহতদের ভুয়া সংখ্যা প্রকাশ করার অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়া মেনে বিচার শুরু হয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের।
এসময় যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তোলে, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া পরিচালনা হলে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করবে কিনা?
এই ইস্যুতে তাদের তৎপরতায় বিশ্বে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন বিষয়টা এমন হয়ে উঠেছিল যে, অপরাধীর গায়ো মানবাধিকার কর্মীর তকমা থাকলে তাকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না। আমরা যদি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আসি, সেখানেও দেখবো একই চিত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার নিয়েও চিন্তিত ছিল। অথচ যুদ্ধের সময় যখন ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, দুই লাখ নারী বীরাঙ্গনা হলেন, শরণার্থী হলেন আরও এক কোটি, তখন তাদের মানবাধিকারের কথা মনে হয়নি; যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো।
এবছরের শুরুতে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন-২০২২ এ জামায়াতে ইসলামীর মানবাধিকার নিয়ে সচেতন দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রকে। অথচ, দলটির গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের নীতিগুলির পরিপন্থী হওয়ায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। ২০১৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর বিধান অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে। যে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে; যুদ্ধাপরাধ ও চরমপন্থায় জড়িত ছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, লিঙ্গ সমতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, সেই দলটি নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ত্রাণকর্তা দাবি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার কারণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং সরকার বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্মনিবন্ধন বা নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। অথচ, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বলে না। তাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলাফেরার স্বাধীনতা, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করা বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়। কিন্তু এই বাস্তুচ্যুতদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্মা আইন প্রণয়ন ছাড়া আর কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
এখন বলতে বাধা নেই উদ্দেশ্যের বাইরে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা না। পাঠক দেখুন, বিএনপির নেতাকর্মীরা শনিবার পিটিয়ে যে পুলিশ সদস্যকে হত্যা করলো, তাঁর মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র বা পিটার হাস প্রায় নীরব। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে পিটার হাস অনেক মন্তব্য করেছেন এতদিন। অথচ ২৮শে অক্টোবর স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা যখন হামলার শিকার হলেন, সেই ব্যাপারেও মার্কিন দূতাবাস কোনো জোরালে মন্তব্য করছে না।
এখনতো বলতে বাধ্য হতে হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সচতনতা পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের এই মানবাধিকার রক্ষার যে উদ্বেগ, সেটার পেছনে সব সময় অন্য উদ্দেশ্য থাকে। তাই মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে নিজেদের স্বার্থের উপর। তারা চায় তাবেদার সরকার, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আর এটা যখন দরকার তখনই কেবল তাদের মানবাধিকার বোধ জাগ্রত হয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।