নিজামুল হক বিপুল
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দুই মাস ধরে মার্কিন ভিসা নীতি সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় মার্কিন মুল্লুক। সেই লক্ষ্যে তারা একটা ভিসানীতি প্রণয়ন করার ঘোষণা দেয় গত মে মাসে। গত সেপ্টেম্বরে এসে সেই ভিসানীতি কিভাবে, কাদের ওপর প্রয়োগ করা হবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দেয় হোয়াইট হাউস।
ওই ব্যাখ্যায় তারা বলে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্টু,, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে যে বা যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে এই ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে। এর আওতায় সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন, র্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য, রাজনীতিবিদ (সে সরকারি বা বিরোধী দল যেই হোক), ব্যবসায়ী এবং নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্টরা এই ভিসানীতির আওতায় পড়বেন। অক্টোবরের ১৮ তারিখে এসে মার্কিন সরকার জানিয়ে দেয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৮ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে ভিসানীতির প্রয়োগ কার্যকর হয়েছে।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে তাদের স্বার্থ জড়িত সেসব দেশকে বাগে আনতে না পারলে ভিসানীতি প্রয়োগ করে। সেই ভিসানীতি সাধারণত ওই দেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োগ করে জানিয়ে দেয়, নির্বাচন পরবর্তি সময় থেকে এই নীতি কার্যকর হবে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা তাদের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতিউৎসাহ দেখিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই তা কার্যকর করার নীতি গ্রহণ করে। যা সত্যিই দুঃখজনক। পৃথিবীর সব দেশে তাদের এক নিয়ম আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেক নিয়ম!
সে যাই হোক, তারা যেহেতু বাংলাদেশে ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে, সেক্ষেত্রে এখন দেখার বিষয় আসলে তাদের এই নীতিতে কারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসছেন। ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, যারাই নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করবে তারাই এই নীতির আওতায় পড়বে।
আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা তৈরিতে তৎপর বিএনপি-জামায়াত জোট। তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে। নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াত জোট গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। কিন্তু কোনো আন্দোলনই সরকারের টনক নড়াতে পারছে না। এই অবস্থায় বিএনপি শনিবার (২৮অক্টোবর) রাজধানীর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের ডাক দেয়। শান্তিপূর্ণভাবে সেই সমাবেশ করার প্রতিশ্রিুতি দিলেও বিএনপি শেষ পর্যন্ত তাদের কথা রক্ষা করতে পারেনি। তারা জ্বালাও-পোড়াও, হত্যার রাজনীতির পুনরাবৃত্তি করেছে।
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে শনিবার রাজধানীতে যে তাণ্ডব দলটির নেতাকর্মীরা চালিয়েছেন সেই চিত্র দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছে। বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরেও এসেছে। ইতিমধ্যে তারা বলেছে, পুরো ঘটনা তারা পর্যালোচনা করবে।
ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে শনিবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘২৮ অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার নিন্দা জানায়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রাজনৈতিক কর্মী হত্যা এবং একটি হাসপাতাল পোড়ানোর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও তেমনই।'
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য আমরা সব সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করব। আমার সব পক্ষকে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানাই।’
শনিবার রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সমাবেশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে সমাবেশ করে। দলটি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করলেও দুপুরের দিকে তাদের সমাবেশে যোগ দিতে গাজীপুর থেকে আসা গাড়িতে হামলা চালিয়ে বিএনপি সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। সেই সংঘষর্ষকেই আরও বিস্তৃীত করে পুলিশ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালনো থেকে শুরু করে হাসপতালে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার কোনো ঘটনাই বাদ রাখেনি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
অর্থাৎ শনিবারের সহিংস ঘটনায় বিএনপি পুরো রাজধানীতে যে তাণ্ডব চালিয়েছে তাতে নির্বাচনের দুই মাস আগেই নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে ফেলছে বিএনপি। যে দায়ভার তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না। এখন ভিসানীতির প্রধান টার্গেটেই পরিণত হওয়ার কথা বিএনপি নেতাকর্মীদের।
দেখার বিষয় হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বলেছে, তাদের ভিসানীতি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। যেহেতু বাংলাদেশে গত ১৮ অক্টোবর থেকে ভিসানীতি কার্যকর বলে ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। সে কারণে শনিবারের ঘটনাও যে ভিসানীতির মধ্যেই ঢুকে গেছে তাতে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি করে বা করবে সেটাই দেখার অপেক্ষায় পুরো দেশ।
লেখক: সাংবাদিক।