বিশেষ প্রতিবেদক
কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে বিএনপি। বিএনপি সরকারের আমলে এই দূরত্ব বেড়েছে অনেকখানি, যা আজও কমেনি। ক্ষমতায় থাকতে নানা ঘটনায় শক্তিধর একাধিক বন্ধু দেশের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল গত ১৫ বছরেও তা আর মেরামত হয়নি। বরং গত দুই বছরে বিএনপির সঙ্গে জার্মানি ও জাপানের সম্পর্ক শীতল হয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালে চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা অনেক দেশের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক ছিল। একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে পরিচিত অনেক দেশই এখন বিএনপির পক্ষে নেই। আবার যারা সরকারের বিপক্ষে রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি দলটি।
২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই অবস্থা থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি দলটি। লবিস্ট নিয়োগ করে লাখ লাখ ডলার খরচ করলেও তা এখন আর কোনো কাজে আসছে না। সমন্বয়হীনতা, গ্রুপিং আর সিদ্ধান্তহীনতার চক্করে আটকা দলটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। সম্পর্ক সহজে ঠিক হবে না জেনে নিয়মিত বৈঠকও করে না বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটি। কমিটির অনেক নেতা জানিয়েছেন সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে।
জানা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপির অনুষ্ঠানে বিদেশিদের উপস্থিতি দিনদিন কমছে। সম্প্রতি বিএনপির এমন দুটি কর্মসূচিতে হাতেগোনা কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি এসেছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে বৈঠকের আলোচ্যসূচি গণমাধ্যমে ব্রিফ না করায় দুই অঞ্চলের সঙ্গে বিএনপির বিদেশ কমিটির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এর একটি দেশ ইউরোপে, অন্যটি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ঢাকায় নিযুক্ত অধিকাংশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানা হচ্ছে না। রুটিন ব্রিফিং কিংবা বিশেষ বৈঠক ছাড়া দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো চেষ্টা হয় না। ফলে বিদেশিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিটির সুসম্পর্ক গড়ে উঠেনি।
কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কমিটির সম্মিলিত কোনো প্রয়াস নেই। সদস্যদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির কোনো কর্মসূচির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। কমিটির সদস্য হিসাবে কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে কয়েক মাস আগে বেশ সক্রিয় দেখা যায়। যে কোনো অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সিন্ডিকেট তাকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রুমিন ফারহানা জানান, আমাকে প্রয়োজন মনে করেনি, তাই ডাকে না। তবে বিদেশি দূতাবাস বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালী একটি দেশের পক্ষ থেকে বিএনপির হাইকমান্ডকে বলা হয়েছে, কূটনৈতিক উইংয়ের শীর্ষ এক নেতার সম্পর্কে তাদের অবজারভেশন রয়েছে। তার ডাকে তারা সাড়া দেবে না। সম্প্রতি জার্মানির পক্ষ থেকেও একই কথা বলা হয়েছে। অথচ এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে অন্য কাউকে দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে না। কূটনৈতিক উইংয়ের মূল ভূমিকা পালনকারী বেশির ভাগ সদস্যেরই প্রতিবেশী একটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন তারা ওই দেশটির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। কিন্তু ওই দেশটিকে এখনো বিএনপি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে পারেনি।
জানা যায়, সিন্ডিকেটটি নিজেরা কাজ করতে না পারলেও অন্যকেও কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিটি দেশের দূতাবাসে ওই সিন্ডিকেট একটি চিঠি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দলের পক্ষ থেকে তিনজন আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখবে। এর বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে বলা হয়েছে। ফলে কমিটির অন্য সদস্যদের অনেকের সঙ্গে কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির নিয়মিত যোগাযোগ হলেও তারা সেটাকে ব্যক্তিগত বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কমিটির এক সিনিয়র সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো দেশের দূতাবাসে গিয়ে নোংরামি করার নাম ডিপ্লোমেসি নয়। ডিপ্লোমেসি জানতে হলে ভূরাজনীতি সম্পর্কে জানতে হয়। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে সে সম্পর্কে আপডেট থাকতে হয়। কিন্তু যারা কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে, তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকি আমাদের সিনিয়র নেতাদের সুযোগও দিচ্ছেন না।
হাতেগোনা কয়েকজন যারা কাজ করছেন, তারাই নিজেদের হাইপ্রোফাইল ভাবেন। বাকিরা তাদের কাছে কোনো নেতাই মনে হয় না। ফলে সুযোগ থাকার পরও আমরা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছি। এখনো সময় আছে হাইকমান্ডকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিদেশিদের ধারণা দিতে বিএনপি গঠিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকে। ২৯ জুলাই অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার আগে আন্তর্জাতিক কমিটির শীর্ষ নেতা বলেছেন, বিদেশিরা শক্তভাবে মাঠে নেমে যেতে বলেছেন। কিন্তু অবস্থান কর্মসূচিতে হামলার পর প্রত্যাশিতভাবে বিদেশিরা প্রতিক্রিয়া জানাননি। ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। ২ আগস্ট এ সম্পর্কে কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেখানে মাত্র ৯টি দেশের প্রতিনিধি এসেছেন। কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত আসেননি। কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন, যারা কূটনীতিক নন। অথচ অনুষ্ঠান আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেখানে ২৫টি দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নীতিনির্ধারকদের একজন ফরেন কমিটির এক সদস্যকে উদ্দেশ করে বলেন, যে অনুষ্ঠানে একজন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত করতে পারবে না, সেখানে আমাদের ডাকার প্রয়োজন নেই। এরপর ১৪ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে একটি সেমিনারে বিদেশিদের আমন্ত্রণ করা হলে তাতে মাত্র চারটি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও তাদের ঢাকাস্থ দূতাবাস কিছুদিন বিএনপির পক্ষে সাফাই আর দফায় দফায় বৈঠক করলেও, এখন তারা ধীরে চলো নীতি নিয়ে পিছুটান দিতে শুরু করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও একইভাবে বিএনপিকে গাছে তুলে দিয়ে মই টান দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন বিএনপির সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন জাগছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারিয়ে কী করবে দলটি? নতুন করে বৈশ্বিক সমর্থন খোঁজ করবে?
মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর পরই বিএনপি হঠাৎ নিজেদের আন্দোলন সাজাতে থাকে। এতে তারা এমনভাবে প্রোপাগান্ডা চালায় যেন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কোলে করে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে যাচ্ছে। এজন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ‘ত্রাণকর্তা’ বলে অভিহিত করেন বিএনপি নেতারা। তাঁকে ‘অবতার’ বলেও স্বীকার করেন দলের মহাসচিব সহ কেন্দ্রীয় নেতারা। সে সময় পিটার হাস একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করতে থাকেন। আর তার সুযোগ নিয়ে নানা অপরাজনীতি করতে থাকে দলটি। এ নিয়ে সব মহলেই সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি ও রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এখন সে দহরম-মহরমে ভাটা পড়েছে। বিতর্ক এড়াতে ধীরে চলো নীতি নিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য ও বিজ্ঞপ্তিতে দূতাবাস কোনো দলকে সমর্থন না করার কথা জানায়। বিতর্ক-সমালোচনার বিপরীতে নিজেদের ব্যাখ্যা দিতে দিতে ‘বিরক্ত’ যুক্তরাষ্ট্র একতরফা সমর্থন থেকে সরে আসছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের সফল কূটনীতির ফলে অনেকটাই সমর্থন হারিয়েছে বিএনপি। বরং ভিসানীতির ভয়ে সহিংসতা করতে পারছে না দলটি। গত ২৯ জুলাই ঢাকার চারপাশে অবস্থান নিয়ে সহিংসতা শুরু করার কারনে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ থেকে বিএনপিকে সতর্ক করার আলোচনাও ছিল।
বিএনপি এখন বসে আছে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন ঘোষণার অপেক্ষায়। তাদের ধারনা যুক্তরাষ্ট্র তাদের মনের কথা মেনে রেখে বাংলাদেশের উপর স্যাংশন দিয়ে দিবে। অথচ বিএনপি’র মন থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূরে। তাই এখন দিশেহারা হয়ে নতুন সমর্থনের খোঁজ করছে বিএনপি।
নিজেদের গা বাঁচাতে সব কিছুই করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, ইতিহাস তাই বলে। বিএনপিকে নিয়ে এমন টানাটানি খেলা এবারই নতুন নয়। ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনের আগেও একই ভাবে পিছুটান দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর বিএনপি সব সময়ই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্ষমতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তাদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, কূটনৈতিক তৎপরতায় তাদের ভুল ছিল। ভুলের মধ্যে প্রথমত, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে যে ফর্মুলা দিয়েছিল, সেখানে ছিল মারাত্মক দুর্বলতা। কারণ সেখানে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্দলীয় সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে সেই সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই ২০ জন উপদেষ্টার আটজনই ছিলেন প্রয়াত এবং চারজন পরে তাঁদের অনিচ্ছার কথা জানান। ফলে কূটনীতিকদের কাছে সেই ফর্মুলা কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি শরিক জামায়াতকে নিয়ে যে আন্দোলন করেছে, তাকে বিদেশিরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তুলনা করেছে। বিএনপি নেতারা কূটনীতিকদের কিছুতেই বোঝাতে পারেননি যে এটি রাজনৈতিক সহিংসতা। তখন জানা গিয়েছিল, খালেদা জিয়ার কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে এসব তথ্য পৌঁছেছে। এ ছাড়া দলের যেসব নেতা কূটনৈতিক তৎপরতায় জড়িত তাঁরাও সময়ে সময়ে সব তথ্য নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার কাছে দিয়েছেন। কিন্তু চূড়ান্ত অবস্থায় তথ্যগুলো সঠিক প্রমাণিত হয়নি।
‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন হবে না’- এ তথ্য তার মধ্যে একটি। এটিকেও কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুম্পর্ক না রাখাকে একটি মারাত্মক ভুল বা ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ভারত, চীন সহ বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালায় তারা। কিন্তু তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে তাতে।
নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপি চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক মেরুকরণ ঘটাতে। এর মাধ্যমে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল যেন আওয়ামী লীগের উপর চাপ সৃষ্টি করে। চাপের ফলে আওয়ামী লীগ যেন নির্দলীয় সহায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ট নির্বাচনের আয়োজন করে। সেই চাপটা বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলকে দিয়ে দেয়াতে পারেনি। তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, বিএনপির জন্য এটা কূটনৈতিক বিপর্যয়।
২০১৮ সালে সহায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে যেন বাধ্য হয়। বিএনপি সেজন্য ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘ পর্যন্ত লবিং করেছিল। বিপুল অর্থ দিয়ে দুইটা লবিষ্ট ফার্মকে এর জন্য নিয়োজিতও করেছিল। কিন্তু দেখা গেছে ফলাফল শূন্য। শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাস বিরোধী কূটনীতি এবং সে সময় রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিদেশীরা ব্যাপক সন্তুষ্ঠ ছিল। তারা শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগকে কোন চাপ দিতে রাজি হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন যে নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহনের জন্য, আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ তখন শেখ হাসিনাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। নেতারা বলেছিলেন, তাদের ধারনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা একটা অপরিহার্য নাম। আগামী নির্বাচনে তিনিই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিবেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘে গিয়ে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোন দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে তারা এমন ভুমিকা নিতে পারে না। গত বছর ১২ জুলাই জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস ও ১৩ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকের পর তারা মুখে কুলূপ এটেছিলেন। দলের কোন সদস্যই এই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছে- আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। তাই বিএনপি নেতারা চুপ ছিলেন।
এছাড়াও ভারতের মন গলাতে আব্দুল আউয়াল মিন্টুর নেতৃত্বে বিএনপির নেতৃবৃন্দ একাধিক উদ্যোগ নিয়েছিল। ভারত স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার যে দৃঢ় অবস্থান, সেই অবস্থানের প্রেক্ষিতে তারা এখন শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবছে না। বাংলাদেশের নির্বাচন কি পদ্ধতিতে হবে, সেটা বাংলাদেশের জনগনের নিজস্ব বিষয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই স্পষ্ট বার্তা বলে প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে আওয়ামী লীগের প্রতি। প্রত্যেকবারই অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভুমিকা থাকে। ওইবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট রোহিজ্ঞা ইস্যুতে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের যে ভুমিকা, তা অতি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। তারা বাংলাদেশে কোন চাপ প্রয়োগ করবে না এমন নীতি গ্রহণ করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবাধ এবং সুষ্ঠ নির্বাচনের ব্যাপারে মোটামুটি স্পষ্ট অবস্থানই ঘোষণা করেছিল। বিশেষ করে বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পরে বলেছিলেন, মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একাধিক সূ্ত্র নিশ্চিত করেছে যে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার যে গঠন তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এবং অবস্থানে পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন হয়ে যায়। কারণ তারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঐক্য প্রক্রিয়া বা অন্য কিছু হবে। তারাও মৌলবাদ সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়ভাবে দাড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে তাদের সন্দেহ তৈরি হয়।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মূল সংগঠন বিএনপি। তাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রয়েছে সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের। এ বিষয়টিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের পরারাষ্ট্র দপ্তরকে অবহিত করে। ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে আগে যে উদ্যোমি ছিল সেটা নষ্ট হয়ে যায়। তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে ধীরে চল নীতি এবং পর্যবেক্ষনের সিদ্ধান্ত নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ক্রিয়াশীল রাষ্ট্র চীন। একাধিক কূটনৈতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের সঙ্গে বানিজ্যিক সম্প্রসারনের যে দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছিল, সেটা তারা অব্যাহত রাখতে চায়। সেখানে বিঘ্ন ঘটাতে চায় না। সবদিক থেকে ব্যর্থ বিএনপি নির্বাচনে যায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তারপর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি ধুয়া তুলে আন্দোলনের চেষ্টা চালায়। তাতেও ব্যর্থ হয়ে শেষে সংসদে যোগ দেয় শেষ মুহুর্তে।
লবিস্ট নিয়োগ করে তার পেছনে লাখ লাখ ডলার খরচ করেও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি দীর্ঘদিন যাবত যুক্তরাষ্ট্রের নাম ব্যবহার করে বক্তৃতা বিবৃতিতে আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পক্ষে আছে- এই মর্মে বিভিন্ন গুজব ও প্রোপাগান্ডাও চালানো হয়ে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিএনপির অবস্থান কী- তা বোধহয় তারা ভেবে দেখেননি। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে বিএনপি টায়ার থ্রি স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত। সম্প্রতি কানাডার আদালত পঞ্চম বারের মত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
২০১৪ সাল থেকে বিএনপির দলীয় পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা একজন আবেদনকারীর আবেদনও মঞ্জুর করেনি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অথরিটি। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও নিউজার্সির অভিবাসন সংশ্লিষ্ট আদালত প্রদত্ত রায়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ বিএনপিকে 'টায়ার-থ্রি' স্তরের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
কানাডার আদালত পাঁচ বার বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে রায় প্রদান করেছে। প্রকৃতপক্ষে কানাডার আদালত যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের নীতিমালা অনুসরণ করেছে মাত্র। সহিংসতা সৃষ্টি, বল প্রয়োগ এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের চেষ্টা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ইন্ধন ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান ইত্যাদি অভিযোগে বিএনপিকে চার বার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কানাডার আদালত। এবার বিএনপি মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ্যাডেলম্যান এন্ড কোং ল অফিস এবং স্টুয়ার্ট শর্মা হার্সাইনি ল ফার্মকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু আদালত তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে পূর্বের রায় বহাল রাখে।
নিজেদের অন্তর্কোন্দল আর নানাবিধ সমন্বয়হীনতায় জর্জরিত বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থ কূটনীতি আর দূর্বল নেতৃত্বের কারনে লাখ লাখ ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেও কোনো সফলতা ঘরে তুলতে পারেনি দলটি। এই ব্যর্থতার ফলে কোনো দেশ বা সংস্থাই এখন আর তাদেরকে সমর্থন করছে না। জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এখন তারা নতুন সমর্থন খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে।