বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির আকার এক হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ আসে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই থেকে। কিন্তু এফডিআই বাড়াতে সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও দিনে দিনে কমছে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ।
দুই বছর আগেও এই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ায় তা বেশ ভালো প্রভাব রেখেছিল অর্থনীতিতে। কিন্তু হঠাৎ করে তা কেন কমছে, এ নিয়ে নানা ধরণের বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে অর্থনীতিবিদ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে।
গত দশ বছরের বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, এ নিয়ে কথা বলেছে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও সরকারের সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সাথে।
অর্থনীতিবিদরা এই বৈদেশিক বিনিয়োগ কমার কারণ হিসেবে ডলার সংকট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা, সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি ও জ্বালানি সংকটের মতো বিষয়গুলোকে মূল কারণ হিসেবে মনে করছেন।অর্থনৈতিক খাতে বড় ধরণের সংস্কার ছাড়া এ অবস্থার উন্নতিও দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ও বর্তমান দুইজন মন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেই কিছুটা কমেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ।বিদেশি বিনিয়োগের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে
বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে নিয়ে আসা অর্থ সংক্রান্ত জরিপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ এই জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ হয় গত ডিসেম্বরের শুরুতে।
রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিলো ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অথচ আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই পরিমাণ ছিলো ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। হিসাব বলছে, বছর ব্যবধানে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫.৫২ শতাংশ।
নিট প্রবাহের এই চিত্রের বিপরীতে বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীরা এই অর্থ বছরে নতুন মূলধন এনেছে অনেক কম। ২০২১-২২ অর্থ বছরে নতুন মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা হলেও গত অর্থ বছরে তা কমে দাড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে। এ হিসেবে নতুন বিদেশি মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ।বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে এফডিআইয়ের প্রবাহ ছিলো ২৫৬ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে ২২৩ কোটি, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি, ২০১৭ সালে ২১৫ কোটি, ২০১৮ সালে ৩৬১ কোটি, ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি, ২০২০ সালে ২৫৬ কোটি, ২০২১ সালে ২৮৯ কোটি। আবার ২০২২ সালে রেকর্ড ৩৪৮ কোটি ডলার আসলেও ২০২৩-এ এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ. মেজবাউল হক বলেন, “গ্লোবাল ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেড়ে গেছে বিভিন্ন দেশে। ফলে ক্যাপিটালের যে ফ্লো থাকে তা স্বাভাবিকভাবে যে সমস্ত দেশে ইন্টারেস্ট রেট বেশি, সে সমস্ত দেশে ফ্লো করে।”
“আমার এখানে কেউ বিনিয়োগ করতে হলে তাকে দুইটা ফ্যাক্টর কনসিডার করতে হয়। তার একটা হলো একচেঞ্জ রেট রিস্ক, আরেকটা হলো ইনভেস্টমেন্ট রিস্ক’।
“যে কারণে ক্যাপিটালগুলো উন্নত দেশের যেখানে এক্সচেঞ্জ রেটের কোনও রিস্ক নেই সেখানে এই মুদ্রাগুলো চলে যায়”, বলছিলেন মি. হক।
বিদেশি বিনিয়োগ কেন কমছে, তা জানতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে যে প্রধান পাঁচটি কারণ খুঁজে পেয়েছে তা একে একে তুলে ধরা হল।
ডলার সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি
গত দুই বছরের টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে সরকারি হিসাবে মূল্য ১১০-১১১ টাকা, কোথাও কোথাও তা নেওয়া হচ্ছে আরও অনেক বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটের কারণে এদেশে বিনিয়োগকারী অনেক বিদেশি কোম্পানি নিজ দেশে মুনাফা নিতে পারেনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের সংকট ও মূল্য ওঠানামা করা। বিনিয়োগকারীরা সবার আগে রিটার্ন নিয়ে চিন্তা করেন। যখন তারা পদ্ধতিগত সমস্যা দেখতে পান তখন তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ডলারের সংকটের কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টাকাও আটকে গিয়েছিল। ব্যাংকগুলো বলেছে তাদের কাছে ডলার নাই। এই বিষয়গুলো বিভিন্ন দেশ দেখে নতুন করে হয়তো আর বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি।”দেশে ডলারের এই সংকট কাটাতে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন বিক্রি হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, “বৈদেশিক বিনিয়োগ বেশি এলে ফাইনান্সিয়াল একাউন্টটাও আমাদের বেটার হয়। যেটা আমাদের ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পজেটিভ ছিলো সেটা আমাদের নেগেটিভ হয়ে গেছে।”
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেন, ‘হয়তো আমরা কমফোর্ট জোনে নাই। তবে, আমাদের ডলার সংকট নাই।”
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন “নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়ে ডলার সংকট কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু এটা দিয়ে ডলার সংকট কাটানো যাবে না। বাজার ভিত্তিক মুদ্রা হারের ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে ডলারের যোগান বাড়ানো কঠিন হবে।”অর্থ পাচার ও দুর্নীতি
ওয়াশিনটন-ভিত্তিক সংস্থা জিএফআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হলে বাণিজ্য গতিশীলতা কমে।
ঘাটতি কমাতে কখনও কখনও বাড়তি কর আদায় করতে হয়। অর্থ সংকটের কারণে সামগ্রিক অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের এক ধরনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেখা যাচ্ছে তাদের টাকা পাঠাতে দেরি হচ্ছে। কারণ পাচার-সহ নানা কারণে ফরেন কারেন্সির রিজার্ভটা কমে যাচ্ছে। এটা এক ধরণের রং সিগন্যাল দিচ্ছে।”
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে আর্থিক খাত নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা বরাবরই ছিলো। এটা আরও বেড়েছে।”
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
গত বছরের শেষে বিদেশি বিনিয়োগ কমার মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, গত বছরের শেষ দিকে বিএনপি জোটের টানা আন্দোলন কর্মসূচি, সংঘাত সংঘর্ষের প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “গত বছর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটা বড় বিষয় ছিলো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকে একটা দোটানায় ছিল ইলেকশন হবে কি হবে না। এ কারণে নতুন করে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহী হননি।”
সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানবলেন, “নির্বাচন নিয়ে এক ধরণের অনিশ্চয়তায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা টানাপোড়েন ছিলো। একটি রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করার জন্য ভীষণভাবে চেষ্টা করেছে। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা গেছে।”
বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেন, “নির্বাচনের আগে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমার বিষয়টা খুবই নরমাল। নির্বাচনের আগে বিদেশি বিনিয়োগ একটু স্লো ডাউন হয়। নির্বাচনের পর এখন বিদেশি রাষ্ট্রগুলো আমাদের ওপর আবার আস্থা রাখছে।”
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো দেশের অর্থনীতি। কিন্তু গত দু বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নানা সংকট দেখা যাচ্ছে।
অর্থনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি-সহ নানা কারণে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নেতিকবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আর্থিক খাত নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা বরাবরই ছিলো, সম্প্রতি এটা আরও বেড়েছে।”
“বিদেশি বিনিয়োগকারীর শুনেছে যে বাংলাদেশে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তার বিল পরিশোধ করতে পারছে না। ডলারে যে বিলগুলো দেওয়ার কথা সেটা পড়ে আছে”।সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “সামষ্টিক অর্থনীতিই যতক্ষণ পর্যন্ত না স্থিতিশীল হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমে না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটু অপেক্ষা করবে বলেই মনে হচ্ছে।”সেবার মান ও জ্বালানি সংকট
বাংলাদেশে যে সব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে তার মধ্যে অন্যতম হলো টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী , পাট, কৃষিভিত্তিক শিল্প ইত্যাদি। বিদেশিদের বিনিয়োগে আগ্রহী করতে বেশ কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে।
কিন্তু এ সব জায়গায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তৈরি করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পর নিষ্কণ্টক জমি নিয়ে যে বাধা ছিলো সেটা কাটানো গেছে। কিন্তু ওয়ান স্টপ সার্ভিস, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবারহ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না।”
এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও কাজ করছে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনীতির দিক থেকে ভারত, ভিয়েতনাম, চীন কিংবা বাংলাদেশের সমতুল্য দেশগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই আসে সে তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই খুবই নগণ্য।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকার যদিও অনেক কাজ করার কথা বলেছে। জমির ঝামেলা মেটানো, গ্যাস বিদ্যুৎ পানি এইসব আমরা দিয়ে দিব এক জায়গায় – এ ধরনের অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক সুযোগই নিশ্চিত করা যায়নি।”
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেন, “আইসিটি, বস্ত্র-সহ বেশ কিছু খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুযোগ আছে। আমাদের দেশের এফডিআইয়ের সুযোগ সুবিধার দিক থেকে শতভাগ রয়েছে। আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ রয়েছে।”
“বাস্তবতা হল, নির্বাচনের পর সরকার গঠন হয়েছে। এখন বিনিয়োগকারীরা যে সকল বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিল তা অনেকটা দূর হয়ে যাবে”, বলেন মি. মান্নান।