নিজামুল হক বিপুল
ভোরের সূর্য উঁকি দিতে তখনও ঘণ্টার বেশি সময় বাকী। যাত্রীদের প্রায় সবার চোখে ঘুম। কেউ কেউ হয়েতো জেগেছিলেন। কিছুক্ষণ পরই সবাই ট্রেন থেকে নেমে নিজ নিজ গন্তব্যে যাবেন। কিন্তু মুহুর্তেই যেন সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা মঙ্গলবারের সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ভোরে খোদ রাজধানীর ভিতরেই যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। প্রাণ গেলো এক শিশুসহ চার জনের। নৃশংস এই অগ্নিকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ডের পর যথারীতি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে এই ঘটনার জন্য হরতাল সমর্থক বিএনপি-জামায়াতকে দায়ি করেছেন। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সরাসরি বিএনপি-জামায়াতের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন।
সোমবার রাতে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে কয়েক শ’ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি। মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার আগে বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রী নামায়। তারপর যথারীতি শেষ গন্তব্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু ভোর পাঁচটা তিন মিনিটের দিকে খিলক্ষেতের কাছে পৌঁছার পরই ট্রেনের দুটি বগির সংযোগস্থলে আগুন দেখতে পান রেলওয়ের স্টাফরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে ট্রেনের ভিতরে শুরু হয় চিৎকার, চেঁচামেছি। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। লোকোমাস্টার দ্রুততার সঙ্গে ট্রেনটি টেনে তেজগাঁও স্টেশনে নিয়ে থামান। ততোক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে।
এক মা, তার শিশু সন্তানসহ মোট চারজনের প্রাণ গেছে আগুনে পুড়ে। এই আগুন কোনো সাধারণ আগুন না, শর্টসার্কিটের আগুন না। এই আগুন হচ্ছে রাজনীতির আগুন। সরকারকে টেনেহেঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর আগুন। মানুষ পুড়িয়ে অঙ্গার করে ক্ষমতায় যাওয়ার আগুন। দেশের সম্পদ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলার আগুন।
গণতন্ত্র পুনুরুদ্ধার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলে আন্দোলনের নামে যে নৃংশসতা রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে তাতে দেশের মানুষের কতোটা লাভ হচ্ছে বা দেশের মানুষ এই রাজনীতি নিয়ে আদৌও ভাবছে কি না- সেটি হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তবে এটা নিশ্চিত মানুষ রাজনীতির নামে এমন নৃশংসতা দেখতে চায় না, প্রত্যাশাও করে না। তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ হচ্ছে দু’বেলা পেট ভরে দু’মুঠো খাওয়া, রাস্তাঘাটে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করা, শান্তিতে বসবাস করা।
মঙ্গলবার ভোরে হরতালের প্রথম প্রহরে খোদ রাজধানীতে ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের যে ভয়াবহ নৃশংসতা ঘটানো হলো তাতে যে মা ও তার শিশু সন্তান এবং আরও দু ব্যক্তি মারা গেছেন তাদের কি অপরাধ ছিলো আমরা জানিনা। তারা কী বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন? না কি তারা বিএনপি-জামায়াতের হরতালে বাধা দিয়েছিলেন? যে ট্রেনটি শত শত যাত্রী নিয়ে হাওরের প্রান্ত থেকে ঢাকায় এসেছিল সেই ট্রেনের-ই বা কী অপরাধ?
তাহলে কেন এই নিরীহ মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারতে হবে? কেন দেশের সম্পদ নষ্ট করতে হবে? আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার এই পথ-পন্থা ছাড়া কি সরকার হঠানোর আর কোনো ভাষা নেই? হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ হত্যা করে তারা কার জন্য রাজনীতি করছেন? রাজনীতি যদি মানুষের জন্যই হয় তাহলে কেন মানুষকেই হত্যা করছেন?
ইয়াছিন নামের তিন বছরের যে শিশুটি আজ আগুনে অঙ্গার হলো তার কী অপরাধ? সে তো মায়ের কোলে নিরাপদে ঘুমিয়ে ছিল। তার মা নাদিরা আক্তার পপি, দূর গাঁয়ের এই পল্লী বধু কি রাজনীতির অ-আ-ক-খ কিছু জানেন, বুঝেন? তাকেই বা মরতে হলো কেন?
হরতাল-অরোধের নামে গত ৩৩ দিনে ট্রেনে আগুন দেওয়ার এটি তৃতীয় ঘটনা। গত ১৬ নভেম্বর টাঙ্গাইল স্টেশনে একটি দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ১৯ ও ২২ নভেম্বর সরিষাবাড়ি ও সিলেটে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর গত ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের ভাওয়ালে ট্রেনের ফিশপ্লেট কেটে ফেলার কারণে মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসেই মঙ্গলবার ভোরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। এর বাইরে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত তিন শতাধিক যানবাহনে হরতাল সমর্থকরা আগুন দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদেরকে পেছনের দিকের অর্থাৎ ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময় বিএনপি-জামায়াত সারাদেশে ভয়াবহ তাণ্ডব ঘটিয়েছিল। বিভিষিকাময় সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও মানুষের গা শিউরে ওঠে।
লেখক: গণমাধ্যকর্মী।