ড. হাসান মো. আল-ইমরান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ও চেয়ারপার্সন তারেক রহমান আবারও একটি ভিডিওবার্তা দিয়েছেন। হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচিতে জনগণ যখন সাড়া দেয়নি—যখন গাড়ি পুড়িয়ে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, রেলের বগিতে আগুন দিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে রুদ্ধ করা যায়নি, তখন তারেক রহমান সুদূর লন্ডন থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সেই বার্তায়।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনে জনসমর্থন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সভা সমাবেশ করছিল। সেই আন্দোলন জনগণের বৃহত্তর অংশকে ছুঁতে না পারলেও, ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি তখন মাঠে থাকতে পেরেছিল। এরপর বিএনপি যখন আবার সংঘাতের পথে অগ্রসর হলো, নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার পরিবর্তে যখন তারা সরকার পতনের এক দফায় চলে গেল, তখন সেখানে গণআন্দোলন তো দূরের কথা, মাঠে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ল তাদের জন্য। তারা ভেবেছিল তাদের দাবির পক্ষে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের অভাব তারা বিদেশি শক্তিকে ম্যানেজ করে পুষিয়ে নিতে পারবে। তাও হলো না।
সরকার পতনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি এখন নির্বাচন বর্জনের পথে গেছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা নির্বাচন করবে কি, করবে না তা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাউকে নির্বাচনে যেতে নিষেধ করা তো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কারণ নির্বাচন ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই। যখন বিএনপির এক দফা আন্দোলন সফল হলো না, তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জে ফেলার সুযোগ বিএনপি নিতে পারতো।
নির্বাচনের মাঠে উপস্থিতি তাদের আন্দোলনকেও চাঙ্গা রাখতে পারতো। তাদের উপস্থিতি, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করতো সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপির নেতৃত্ব এই সুযোগ নিতে পারলো না। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, তিনি সাজাপ্রাপ্ত হয়েও সরকারের নির্বাহী আদেশের সুযোগ নিয়ে বাসা অথবা হাসপাতালে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় বিএনপির সিদ্ধান্ত আসছে লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমানের কাছ থেকে। অথচ এদেশে যারা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা জেল-জুলুম সয়েও জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছেন।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব দেয়া বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রধান হিসেবে তারই ছেলে তারেক জিয়া বিদেশে পালিয়ে আছেন। কিন্তু তিনি যদি পালিয়ে না থেকে দেশে ফিরে লড়াই করতে পারতেন, তাহলে হয়তো সফল হতে পারতেন। জনগণের একটা বড় অংশই হয়তো হাওয়া ভবনের কীর্তিকলাপ ভুলে নতুন করে তার প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন। কিন্তু তা না করে, গণসম্পৃক্ততা না বাড়িয়ে, একের পর এক আক্রমণাত্মক কর্মসূচি দিয়ে তিনি গণবিচ্ছিন্নতার পথেই হাঁটছেন।
আসলে দেশে না থেকে দেশের পরিস্থিতি কখনই বোঝা সম্ভব নয়, তারেক রহমানও স্বাভাবিকভাবেই তা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ৭ জানুয়ারি ২০২৪, নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয়েছে। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলেও যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের উৎসাহ ও প্রচার ইতিমধ্যেই চোখে পড়ছে। এই অবস্থায় হরতাল অবরোধ দিয়ে, নাশকতা করে যে নির্বাচন ঠেকানো যাবে না, তা সবাই বুঝতে পারছেন। ২০১৩-১৪ সালে এরচেয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও বিএনপি জামায়াত নাশকতা অগ্নিসন্ত্রাস করেও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতে পারেনি।
আজকের এই পরিস্থিতিতে শেষ চেষ্টা হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচির ডাক বিএনপির গণবিচ্ছিন্নতাকেও আরও প্রকটভাবে উন্মোচিত করেছে। আমাদের উপমহাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন ও অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন ব্রিটিশ রাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু, জনগণের কাতারে থেকে একদিকে যেমন স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে কার্যত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের সব কর্তৃত্ব অকার্যকর করে দিতে পেরেছিলেন।
জনগণ যখন অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, যখন নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম গড়ে তোলে, সেই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতার নেতৃত্বে জনগণ রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। অসহযোগ আন্দোলন সেই পরিস্থিতিরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। অথচ জনভিত্তি না দাঁড় করিয়ে, গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সফল না হয়ে, হরতাল অবরোধের মতো এককালের জনপ্রিয় কর্মসূচিকে অকার্যকর বানিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচি ঘোষণা হাস্যকর বটে। লন্ডনে বসে থাকা কারও ডাকে জনগণ ট্যাক্স, ইউটিলিটি বিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের নাগরিক সুবিধাগুলো ঝুঁকির মুখে ফেলবে, এ ভাবনার পুরোটাই দিবাস্বপ্নের মতোই শোনায়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।