ধ্রুব হাসান
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পোষা মিডিয়া ব্যবহার করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষায় সমর্থন করে তারা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মনগড়া মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করছে পৃথিবীর সামনে। গত নভেম্বরের ২২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইনস্টিটিউট অব পিস’ নামের সংস্থার ওয়েবসাইটে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে কাল্পনিক তথ্যে ঠাসা এক বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়েছে।
Ahead of Election, Bangladesh’s Political Turmoil Spills into the Streets শিরোনামের লেখাটি লিখেছেন জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড। তার সম্পর্কে পরে বলছি। প্রথমে তার লেখায় কী আছে, দেখা যাক। তিনি লিখেছেন, জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন যত কাছে আসছে, ততই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন নাকি দেশের রাস্তা ও রাজনীতিকে উত্তাল করে তুলেছে।
রাস্তা ও রাজনীতির উত্তাল হওয়া বলতে জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড কী বোঝেন, তা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারছে না। গত ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর থেকে বিএনপি দেশে ৮ ডিসেম্বর সকাল ছয়টা পর্যন্ত সারাদেশে ২৭৯টি অগ্নিসংযোগ এবং স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে ভাঙচুরের ঘটনাও আছে। অগ্নিসন্ত্রাসের তাৎক্ষণিক ভীতি থেকে জনসাধারণ কয়েকদিন স্বাভাবিক জীবনযাপনে সাবধানতা দেখালেও বিএনপির ইদানিংকার সহিংস কর্মসূচিগুলো আর গায়ে মাখছে না মানুষ। একে কীভাবে ‘উত্তাল’ হওয়া বলা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে নানা ইস্যুতে প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়াতে যতটুকু বা দেখা যায়, তার উত্তালতা তো বিএনপির কর্মসূচির চেয়ে ঢের বেশি। আর লুকিয়ে লুকিয়ে ফেসবুক লাইভ করে কতটুকুই বা উত্তাল আন্দোলন করা যায়?
২৮ অক্টোবরের সহিংসতা বর্ণনা করতে গিয়ে জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, জামায়াতে ইসলামী আর বিএনপির এক দফা দাবির মহা সমাবেশের কথা। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের কথাও রয়েছে তার লেখায়। কিন্তু সহিংসতার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা পড়লে বোঝা যায়, তিনি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা না পড়ে বা টিভি না দেখেই তার লেখা দাঁড় করিয়েছেন। নয়তো, পুলিশের সাথে বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের মিথ্যা তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? তার লেখাতেই আছে, বিরোধী সমর্থকরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ও বেশ কয়েকজনকে গুরুতর আহত করেছে, একটি হাসপাতালে আগুন দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করেছে এবং সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছে। ৩০ জন সাংবাদিক গুরুতর আহত হয়েছেন সেদিন। সংঘর্ষ তো হয় দুই পক্ষে। মহাসমাবেশের নামে এমন সহিংস তৎপরতাকে ‘সংঘর্ষ’ নাকি ‘হামলা’ বলে?
বিএনপির মুখপাত্রের মতো জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, দলটির আন্দোলনকে বিতর্কিত করার জন্য সরকারই সহিংসতা ঘটিয়েছে। অথচ সেদিনের সেই পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাভার উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফাকে। এটি ১০ নভেম্বরের খবর। ২৮ অক্টোবর কাকরাইলে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ‘প্রেস’ লেখা জ্যাকেট পরা যুবদলের ঢাকা দক্ষিণের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম নয়নকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে টাকার বিনিময়ে বাসে অগ্নিসংযোগ করে গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংখ্যা তো ভুরিভুরি। এসব তথ্য জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ডের বিশ্লেষণে নেই। বরং বিএনপির সমর্থকদের হয়ে মরাকান্না কেঁদে গেছেন পুরো লেখাজুড়ে। তার মতে বিএনপি এসব করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বারবার ‘অস্থির’ বলে উল্লেখ করে জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড স্বীকার করেছেন, এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে। গত দুই বছরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা সরকারগুলো নাকি ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলির উন্নতির জন্য চাপ দিয়েছে৷ একটি স্বাধীন দেশের নিজস্ব ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করছে তার দেশ ও মিত্রদেশের জোট। এমন সরল স্বীকারোক্তির জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া যায়।
বিএনপি পশ্চিমা চাপকে গ্রহণ করেছে, এক বিএনপি নেতা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে দলের ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করেছেন: জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ডের লেখায় তুষ্টি। তার লেখায় আরও আছে, ২৮ অক্টোবর সহিংস সংঘর্ষের পর বিএনপির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছিলেন যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমা সরকারের কাছে জবাবদিহি করবে। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের কাছে বাংলাদেশের কেন জবাবদিহি, কীসের জবাবদিহি? বাংলাদেশ কি পশ্চিমাদের করদ রাষ্ট্র? কীসের আসায় পশ্চিমাদের সামনে এতই নতজানু বিএনপি?
জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, পশ্চিমা দূতাবাস, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এবং তাদের দেশীয় মিত্ররা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ করা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। কিন্তু লাভ হয়নি। তাকে ত্রাতা মানা বিএনপি সংলাপের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কিন্তু প্রস্তুত ছিলো আওয়ামী লীগ। ৭ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সংলাপের রাস্তা এখন বন্ধ। মনে রাখতে হবে, তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে। আওয়ামী লিগ ও বিএনপি আলোচনায় বসতে রাজি হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যে কঠিন, তা জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড বোঝেন। নির্দলীয় সরকারের মতো সংবিধানবহির্ভূত ব্যবস্থা তো আর আসবে না।
লেখার শেষে এসে বিএনপির সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের পুলিশের কার্যক্রমকে ‘প্রতিশোধ’ বলে উল্লেখ করেছেন জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড। এ কেমন শব্দ চয়ন? যানবাহনে আগুন দেয়া, বাসে ঘুমন্ত মানুষকে জীবিত পুড়িয়ে মারার মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঠেকাতে গেলে দোষ? মার্কিন তাবেদারদের বিপক্ষে দাঁড়ালেই দোষ?
জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ডের পরিচয়টি এবার জেনে নিন। এই ব্যক্তি ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়া বিভাগের একজন সিনিয়র উপদেষ্টা। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে আইআরআই-এর আবাসিক প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ছিলেন। তখন তিনি সুশীল সমাজের ক্ষমতায়নসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। আইআরআই একটি মার্কিন সংস্থা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে চলে। বিভিন্ন দেশের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা করা এবং পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে কাজ করে সংস্থাটি।
সেই মার্কিন ব্যবস্থাপত্রের গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র ফেরি করতে গিয়ে পৃথিবীজুড়েই মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একুশ শতকের শুরু থেকে, দেশটি সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে ৮৫টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে কমপক্ষে ৯ লাখ ২৯ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ৩৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২০টিরও বেশি দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে গণতন্ত্রের একমাত্র পরিবেশক যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে দেশগুলোর জনগণের পক্ষে খাদ্য এবং ওষুধের বন্দ্যোবস্ত করাও কঠিন হয়ে গেছে। মার্কিন গণতন্ত্রেই কি পেট ভরবে তাদের?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।