এনামুল আহসান
গোলপাতা ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উপকূলীয় এবং মোহনা এলাকার এক প্রকার পাম জাতীয় উদ্ভিদ, যাদেরকে নিপা পাম নামে ডাকা হয়। এটি পামের একমাত্র প্রজাতি যা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটা মূল গণ নিপা হতে উদ্ভত একমাত্র প্রজাতি যার উপ প্রজাতি নিপোডিয়া।
গোলপাতা গাছগুলো নদীর পার জুড়েই জন্মে তবে জোয়ার ভাটা থাকতে হবে এবং লবনা্ক্ত পানিতেই তার বেশী দেখায়। গোলপাতার গাছ বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দেশের সমুদ্রতীরবর্তী অংশে জন্মে। বাংলাদেশ ছাড়া ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েৎনাম, শ্রীলঙ্কায় জম্মাতে দেখা যায়। এর পাতা নারিকেল পাতার মত এক প্রকার লম্বা পাতা বিশিষ্ট গাছ বিশেষ। পাম গোত্রের তালগাছ সদৃশ এই গাছ আকৃতিতে ছোট। এর কাণ্ড মাটির নিচে অনুভূমিক বিস্তার লাভ করে। শুধু এর পাতা এবং ফুল মাটির উপরে দৃশ্যমান হয়। এর ডাঁটাসহ পাতার ফলক দৈর্ঘ্য ৮ থেকে ১০ ফুট হয়ে থাকে। এর লাল রঙের স্ত্রীফুল উপরের দিকে ফোটে। পক্ষান্তরে হলুদ পুরুষ ফুলগুলো অপেক্ষাকৃত নিচুতে ফোটে। এর ফল জাম্বুরা মত বড়। ঘর ছাওয়া ও ঠোঙা বানানোর জন্য গোলপাতা ব্যবহার করা হয়। গোলপাতার ফল অনেকটা তাল শাঁশের মত। এই গাছের পাতা ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। ভোলার চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র পরিবারের কাছে এখনো জনপ্রিয় বনের গোলপাতা। অল্প টাকায় তৈরি হয় গোলপাতার ঘর। ফলে তারা গোলপাতায় তৈরি ঘর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত ইউনিয়নের নাম চর কুকরী-মুকরী। এখানে রয়েছে বন বিভাগের ৮ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল। নান্দনিক এসব বনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খালের দুই পাড়ে ও ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে নারিকেল গাছের পাতার মতোই ছোট ছোট গোলপাতা গাছ। বন বিভাগের আওতায় চরাঞ্চলে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এসব গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে। বন প্রহরীরা এসব গাছের পরিচর্যা করেন। নিজস্ব নার্সারিতে গোলপাতা গাছের বীজ রোপণের পর পরিচর্যার এক পর্যায় ৯ থেকে ১০ ইঞ্চি হলে সেগুলো নিয়ে খালের পাড়ে এবং বনের ভেতরে রোপণ করা হয়। নোনাজলে জন্ম, নোনা সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ এর ডগা (ডাণ্ডি) থেকে বেরিয়ে আসছে মিষ্টি রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড় (মিঠা)। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পরিবার কয়েক বছর ধরে এই গুড় তৈরি করছে। এখানে গোলপাতার চাষও করা হয়। সাধারনত আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডাণ্ডিতে গাবনা ফল হয়। পৌষ মাসে ফলসহ মাটিচাপা দিয়ে ডাণ্ডি নুয়ে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসে ডাণ্ডিটি মানুষের পায়ের আলতো লাথি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে রসে ভার করার জন্য দোয়ানো হয়। ১৫ দিন এভাবে দোয়ানোয় পর গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডগার মাথা থেকে গাবনা ফলের থোকা ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাণ্ডির কাটা অংশ তিন দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুইবেলা পাতলা করে (একসুত পরিমাণ) কেটে ফেলা হয়। এভাবে চলে আরো ১৫ দিন। এরপর প্রতিদিন বিকেলে একবেলা ডাণ্ডার মাথা দিয়ে কিঞ্চিত অংশ কেটে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। পরদিন খুব ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর পৌষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে রস সংগ্রহ করা। প্রতিটি ডাণ্ডি থেকে ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। কমপক্ষে এক একর জমির বাগানের ১৫০টি ডাণ্ডি থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ হয় ৪/৫ কলসি। প্রতি কলসিতে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। এভাবে প্রতিদিন ১০০ লিটার রস সংগ্রহ হয় সম্ভব। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসিতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় উৎপাদন করা হয়। এখানে একটা কথা বলা প্রযোজন, শিয়ালের উপদ্রপ আছে, পাতি শৃগার হাড়ি ভেঙ্গে ফেলে আবার রশি ছিরে হাড়ি নিয়ে যায়। সাবধানতা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি। ১০০ পিস ছাউনি বিক্রি করা হয় ৬০০ টাকায়। প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট লম্বা ডাণ্ডাসহ গোলপাতা ৮০ পিস বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকায়। 'লাকড়ি হিসেবে গোলপাতা বাগানের মরে যাওয়া মুথা (ডাটা) ব্যবহার করা হয়। কলাপাড়া এলাকার গোলবহরের (বাওর) একজন মালিকের 'গোলবাগান থেকে যে লাভ হয় তা সরল জমিতে ধানচাষ করে হয় না। সাধারনত লোনা পানিতে ধান চাষ তেমন ভাল হয় না। তাছাড়া এক একর জমিতে ধান পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২৫ মণ। ৭০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করে প্রতি বছর সাড়ে ১৭ হাজার টাকা আয় হবে। এভাবে সাড়ে তিন মাস রস দিয়ে গুড় তৈরি করা সম্ভব। শুধু গুড় দিয়ে প্রায় এক লাখ টাকা আয় হয়। গোলপাতা দিয়ে আরো ২০ হাজার টাকা আয় হয়। কলাপাড়া পৌর শহরে বিক্রি হয়। বরিশাল শরুপকাঠি থেকে বড় বড় নৌকা আসে, তারা এই গোল পাড়া কিনে নিয়ে ।
গোলপাতার রস খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশী, 'গোলের রস খেলে পেটের কৃমি দমন হয়। মানুষের শরীরের পানিশূন্যতা দূর করে, কর্মক্ষমতা বাড়ায়। আখের রসে শর্করা থাকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। গোলগাছের রসে শর্করা থাকে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ। কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের খাদায় কিংবা খালের তীরে গোলবহর রয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের দিকে বন বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে সুন্দরবন থেকে গোলবহরের বীজ (গাবনা) সংগ্রহ করে রোপণ করে বাগান তৈরি করা হয়। এরপর থেকে স্থানীয়রাও নিজ উদ্যোগে কৃষি জমির অভ্যন্তরের খালের তীরে গাবনা রোপণ করে বাগান তৈরি করেন। কলাপাড়াসহ উপকূলীয় এলাকায় গোলগাছের গুড়ের চাহিদা রয়েছে অনেক। এটি এ অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি গোলগাছ পাতাসহ উচ্চতা হয় ১২ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত। এর ফুল হয় হলুদ এবং লাল। ফুল থেকে গাবনা পরিপক্ব হলে সেটি তালগাছের আঁটির মতো কেটে শাস খাওয়া যায়। এ গাছ নোনাজলে জন্মায় এবং সুস্বাদু গাবনা দিয়ে গাছ গজায়।
গোলগাছের চাষ অত্যন্ত লাভজনক এবং সহজসাধ্য । গোল চাষে খরচ কম এবং ব্যয়ের অনুপাতে আয় হয় অনেকগুণ বেশি কারণ চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিশেষ প্রয়োজন হয় না। গাছের বিশেষ কোন পরিচর্যা করতে হয়না। গাবনা বা গোলগাছের বীজ সংরক্ষণ করে তা নোনা জমিতে পুঁতে দিলেই চারা গজায়। একটি গোল-ছড়ায় একশ থেকে দেড়শটি বীজ থাকে ফলে একটা ছড়া থেকে দেড়শো গোল গাছ পাওয়া যায়।
ম্যানগ্রোভ বা উপকূলীয় বনাঞ্চলে গোল গাছ প্রাকৃতিক ভাবে জন্মে। কলাপাতা উপজেলায় গোলগাছ চাষ করা হয় নিচূজলাভূমি, খালের পাড় ইত্যাদি জায়গায় যেখানে নোনাপানি সহজলভ্য। গোল গাছের বেড়ে ওঠার জন্যে লবনাক্ত পানি অপরিহার্য।