দৈ. কি. ডেস্ক: গত অর্থবছর রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে প্রথম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। দেশটি থেকে প্রায় ৩১ শতাংশ কমেছে। আলোচ্য সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে। তবে সৌদি আরব থেকেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।
প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমেই বাড়তে থাকার কারণে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যয় বাড়ার কারণে এসব দেশে প্রবাসীরা আয় থেকে সঞ্চয় করা কমিয়ে দিয়েছেন। এদিকে এলসি নিষ্পত্তিতে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা ব্যাংকগুলোকে বেশি দাম দিয়ে হলেও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পরামর্শ দেয়ার কারণে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম ৯ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭.০৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬.০৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১.৯৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২.৮০ বিলিয়ন ডলার। ফলে শীর্ষ রেমিট্যান্সের উৎস দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে নেমে গেছে যুক্তরাষ্ট্র।
রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ৩১ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময় শেষে যা ছিল ২.৭৬ বিলিয়ন ডলার। দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসা কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এর বাইরে কুয়েত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার ও জাপান থেকেও রেমিট্যান্স আসা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
তথ্য বলছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৬৫ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ বা ১৫.৬৭ লাখ কর্মীই গেছেন সৌদি আরবে। সে হিসাবে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ গত দুই বছর ধরে কমছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে প্রথম স্থানে থাকা সৌদি আরব গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শীর্ষস্থান হারিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে সৌদি আরবের অবস্থান আরও অবনতি হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, অনেক দেশেই প্রবাসীদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে তাদের আয় থেকে করা সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে গেছে। আবার কিছু দেশ এমনও আছে যারা আউটওয়ার্ড রেমিট্যান্সে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। রেমিট্যান্স কমার পেছনে এগুলোই বড় কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ওদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩.২৭ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২.২০ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ বা ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
ফলে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসা দেশের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত গত অর্থবছরের তৃতীয় স্থান থেকে চলতি অর্থবছরে প্রথম স্থানে চলে এসেছে। আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে পাচার করা অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। একজন ব্যাংকার আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার পেছনে পাচার করা অর্থ ফেরত আসার কথাই জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে আরব আমিরাত থেকে মাসে ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পায় বাংলাদেশ। তবে নভেম্বর থেকে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসা বাড়তে থাকে। গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আরব আমিরাত থেকে প্রতি মাসে রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। তথ্যানুসারে, মার্চ মাসেও ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশটি থেকে।
একই প্রবণতা দেখা গেছে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স আয়েও। বেশি রেমিট্যান্স আসা দেশের তালিকার চতুর্থ অবস্থান থেকে দেশটি উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২.১৪ বিলিয়ন ডলার; আগের অর্থবছরের ১.৪৬ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় যা ৪৬ শতাংশ বেশি।
সিঙ্গাপুর থেকে রেমিট্যান্স আসা বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। এর বাইরে মালয়েশিয়া, ওমান, ইতালি, জার্মানি ও বাহরাইন থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আরেক ব্যাংকার বলেন, হুট করে উপসাগরীয় দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ গত কয়েক বছরে দেশটিতে খুব বেশি নতুন শ্রমিক যাননি। সর্বশেষ তিন বছরে মাত্র ২.২৯ লাখ শ্রমিক গেছেন আরব আমিরাতে।
ওই ব্যাংকার বলেন, শ্রমিকের আয় থেকে যদি রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হতো, তাহলে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্সের। কারণ দেশটিতে শ্রমিক গেছে আরব আমিরাতের চেয়ে প্রায় সাতগুণ বেশি। সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স উল্টো কমে যাচ্ছে।
এদিকে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। জানা গেছে, ঈদের পর থেকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ১১৬-১১৭ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। অন্তত ১০-১২টি ব্যাংক এই রেটে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করছে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রেমিট্যান্সের এই ডলারের দাম ১১২.৫ থেকে ১১৩ টাকায় নেমে গিয়েছিল। অবশ্য ফেব্রুয়ারির শেষে রেমিট্যান্সের ডলারের জন্য ১২০-১২২ টাকা পর্যন্ত অফার করেছিল ব্যাংকগুলো।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য মতে, চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ১৯ দিনে বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১২৮ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় (প্র?তি ডলার ১১০ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।