বিশেষ প্রতিনিধি
প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় সেসব তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার এজেন্ডা হিসেবেই দেওয়া হয়। কখন কোন রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের ধরণ কী হবে সেসব বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে এসব এজেন্ডা নির্ধারণ করে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আধিপত্য বজায় রাখতে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এধরনের প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। যেকারণে এবছর বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর যে দোষগুলো মার্কিন প্রতিবেদনে ধরা পড়ছে, গতবছর সেইসবকেই তারা প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তারা এও বলছেন, প্রশ্ন তোলা দরকার- কী কারণে তারা হঠাৎ নেতিবাচক হয়ে উঠলেন।
পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী স্পেশাল ওয়েপনস এন্ড টেকটিকস ডিভিশনের (সোয়াত) এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের সুযোগ নেই বলে তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেররিজম–২০২২’–এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে যে যে অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে পুলিশের আইনশৃঙ্খলারক্ষার নানা প্রক্রিয়ার কথাই উঠে এসেছে। এগুলো সেইসব নিয়মিত কার্যক্রম যা কিনা ২০২১ এর স্টেট ডিপার্টমেন্ট রিপোর্টে প্রশংসিত হয়েছিলো। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন কেনো তাদের এসব নিয়ে বাড়তি ‘কনসার্ন’ সেটি বিবেচনা করা জরুরি।
এর আগে বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ঘৃণাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার কারণে বেশকিছু হতাহতের ঘটনা ঘটলেও, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার সন্ত্রসাবাদ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ওপর জোর দিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো অনলাইনে নিয়োগ ও সহিংস ঘটনায় অর্থায়ন বাড়ালেও, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিট অধিকাংশ হামলা প্রতিরোধ করেছে এবং সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসিইউ), অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান ও গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। এসব ইউনিটের বেশকিছু সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, ‘অন্যান্য কাউন্টার টেরোরিজম সম্পর্কিত ইউনিটগুলোর মধ্যে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ডস, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে কাজ করেছে।’
অথচ ঠিক একবছর পরে একই বিষয়ে তাদের মন্তব্য ঘুরে যেতে দেখা হয়। এবছর প্রতিবেদনে তারা বলছে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বেশ কিছু ইউনিট বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
কেনো এধরনের দ্বিচারিতা তাদের প্রশ্নে জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এধরনের প্রতিবেদন নৈতিক জায়গা নিয়ে প্রগতিশীলদের একধরনের রিজার্ভেশন আছে। এসব রিপোর্টে তাদের পররাষ্ট্রনীতি ফুটে ওঠে। তারা এসব তৈরি করে নতুন আধিপত্য তৈরি ও পুরোনো আধিপত্য টেকানোর জন্য। সেখানে সত্য মিথ্যা দিয়েই হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আগ্রহ ও স্বার্থের বাইরে একটা কথাও কখনও উচ্চারণ করবে না। তাদের যেখানে হস্তক্ষেপের ইচ্ছে হবে সেখানেই তারা নানা কায়দা বের করবে। আমাদের এখানে তারা সরকার পরিবর্তনের এজেন্ডার মধ্যে আছে। যেকোন কারণেই হোক, তারা হস্তক্ষেপ বাড়াতে এটা চেষ্টা করছে। এবং তাদের কাছে আমাদের দেশ থেকে যারা তথ্য উপাত্ত দেয় তারা কোন না কোন ভাবে তাদের সুবিধাভোগী কনসালটেন্ট। তারা সেইসব জায়গায় অর্থায়ন করে যেখানে তাদের কাজ বের হবে। এখানে সোয়াতের সঙ্গে তাদের নিশ্চয় আর কোন যুক্ততার দরকার নেই। সেকারণে কিছু অভিযোগ তুলে বিষয়টা জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছে।’
কিসের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এসব রিপোর্ট করে প্রশ্নে নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. জে. (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘এটা ওরা স্পষ্ট করতে পারবে। তবে, কিছুদিন আগে তারাই বলেছে, বাংলাদেশ পুলিশের মানবাধিকার রক্ষণের মাত্রা বেড়েছে। এখন তারাই বলছে উল্টো। আসলে আগামী নির্বাচনে বিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে যা করার তারা সেটাই করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা প্রশিক্ষণে অর্থ না দিলে সোয়াত বন্ধ হয়ে যাবে এটা ভাবার কারণ নেই। তাদের কাছ থেকে টেকনোলজি ও টেকনিক শেখার প্রশিক্ষণ নেওয়াটা সহযোগিতামূলক বিষয় ছিলো। সেটা না করতে চাইলে না করবে। তাতে সোয়াতের কার্যক্রমে খুব বেশি ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমি মনে করি না।’