দৈ. কি.ডেস্ক : কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ির ভিটায় ঐতিহ্যবাহী কালভৈরব বৈশাখী মেলা এবার বসেনি। রীতি অনুযায়ী গত বুধবার সাত দিনব্যাপী মেলা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত সামনে এনে উপজেলা প্রশাসন এবার মেলা আয়োজনে অনুমতি দেয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় একটি পক্ষ জেলা প্রশাসকের কাছে বন্ধের আবেদন করে। মূলত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে ঐতিহ্যবাহী মেলাটি এবার হয়নি। মেলা বন্ধ হওয়ায় একদিকে যেমন দর্শনার্থীরা হতাশ, অন্যদিকে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
কটিয়াদী সাহিত্য সংসদের সভাপতি মেরাজ রাহীম বলেন, সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়িটি ঐতিহাসিক স্থান। মেলা ঘিরে অসংখ্য মানুষের পদচারণ হতো ঐতিহাসিক স্থানটিতে। কারও স্বার্থের কারণে মেলা বন্ধ হওয়া মানে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত করা। দেরিতে হলেও মেলা আয়োজনের দাবি জানান মেরাজ। একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয় অনেক বাসিন্দা।
উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া ইউনিয়নের মসূয়া গ্রামে। একসময় সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষেরা নিজ বাড়িতে ঘটা করে কালভৈরব পূজার আয়োজন করতেন।
লোকমুখে প্রচার আছে, কালভৈরব পূজাকে উৎসবের মাত্রা দিতে ২০০ বছরের অধিক সময় আগে রায় পরিবারের পূর্বপুরুষেরা শিশুসাহিত্যিক হরি কিশোর রায় চৌধুরী বাড়ির পাশে কালভৈরব বৈশাখী মেলার প্রচলন করেন। সেই থেকে প্রতিবছর বৈশাখের শেষ বুধবার থেকে কালভৈরব বৈশাখী মেলা আয়োজন হয়ে আসছে।
দিন দিন মেলার আকার ও প্রসার বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে মেলায় তিন শতাধিক বাহারি পণ্যের দোকান বসে। সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা তো বটেই, মেলার দোকানপাটের সারি চলে যায় মসূয়া বাজারে এবং পুরো এলাকায়। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কবি–সাহিত্যিকদের আগমন ঘটে মেলায়; হয় কবিতা পাঠ ও সাহিত্যচর্চা। প্রতিদিন গড়ে লোকসমাগম ঘটে ১০ হাজারের অধিক। মেলা আয়োজনে রায় পরিবারের চার একর জমি ব্যবহার করা হয়। মেলাটি কটিয়াদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেলাটির অবস্থান মসূয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এত দিন স্থানীয় লোকজন মিলেমিশে মেলা পরিচালনা করে আসছিলেন। কয়েক বছর ধরে ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহ জালাল ও ২ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য ফজলুর রহমান মেলা আয়োজনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মসূয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রুবেল হোসেনের নেতৃত্বে একটি পক্ষ বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। পক্ষটি মেলায় নিজেদের বলয়ের অংশগ্রহণ বাড়াতে চাচ্ছিল। এই নিয়ে মতবিরোধ থেকে পক্ষ দুটির দূরত্ব বাড়ে।
একপর্যায়ে মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে রুবেল নিজে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করেন, বুধবার মেলা হওয়ার কথা। ওই দিন লাগোয়া উপজেলা পাকুন্দিয়ায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ ছাড়া কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলার পোড়াবাড়ির মেলায় সংঘাত হয়। সংঘাতে খুনের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এ অবস্থায় মেলাটি হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহ জালাল বলেন, নিরাপত্তা কিছু নয়। মূলত রুবেলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আনা হয়। বনিবনা হয়ে গেলে নিরাপত্তার বিষয়টি বালিশের নিচে রয়ে যেত।
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার বয়স ৭৪ বছর। ১৫ বছর বয়স থেকে মেলা আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। করোনা পরিস্থিতি ছাড়া মেলা বন্ধ হয়নি। এবার হয়েছে। তা–ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে।’
তবে রুবেল আহমেদ জানান, বনিবনা কিংবা অন্য কোনো স্বার্থের কারণে তিনি মেলা বন্ধের আবেদন জানাননি। আবেদন জানিয়েছেন মেলাকে ঘিরে সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে। কারণ, আগেও এ মেলায় অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মেলার শুরুর দিন পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ছিল। ২১ মে হবে কটিয়াদী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এসব আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় রেখে মেলাটি স্থগিত রাখা হয়। তবে কিছুদিন পর মেলাটি আয়োজন করা যায় কি না, বিবেচনা করে দেখা হবে।