ভারতের সঙ্গে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের প্রথম ঋণচুক্তি হয়, যা প্রথম লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। এই এলওসির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ২০০ কোটি ডলার ও ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসি তথা ঋণচুক্তি হয়। তিন এলওসি মিলিয়ে বাংলাদেশকে ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত।
কিন্তু এত প্রতিশ্রুতির পরও কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থ ছাড় হয়নি। গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ছাড় হয়েছে মাত্র ১৬৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম এলওসির ৮০ কোটি, দ্বিতীয় এলওসির ৪০ কোটি ও তৃতীয় এলওসির ৪৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রথম এলওসির ১৮ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক এই ঋণ দিচ্ছে।
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি শেষ হয়েছে। চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ কিংবা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় ঋণ ছাড়ে অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের তুলনায় গতি কম। এর অন্যতম কারণ ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে কেনাকাটার ৭৫ শতাংশ ভারত থেকেই করার শর্ত থাকে। বিশেষ করে নির্মাণ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকেই করতে হয়। এ ধরনের প্রকল্পের আরেকটি শর্ত হলো, কমপক্ষে ১০ শতাংশ কেনাকাটা করতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কেনাকাটার জটিল শর্তকেই অর্থ ছাড়ে অন্যতম প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিকাদারেরা কাজ পাওয়ার পর কেনাকাটার শর্তের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ কম দেখান। যেমন হাইটেক পার্ক নির্মাণের একটি প্রকল্পে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। ওই ঠিকাদার ভারত থেকে ৭৫ শতাংশ কেনাকাটার শর্তের কারণে প্রকল্প থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই হয়ে থাকে। এই শর্ত শিথিল করা হলে ভারতীয় ঋণের অর্থ ছাড় বাড়তে পারে ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণে আরও কিছু সমস্যা আছে। যেমন প্রতিটি ধাপে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আর প্রকল্পের কাজ পাবেন শুধু ভারতীয় ঠিকাদারেরা। আবার প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগের প্রতিটি ধাপেই এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয়। ফলে ঠিকাদার নিয়োগ করতেই এক–দুই বছর সময় চলে যায়। ঠিকাদারেরা অনেক সময় বেশি দর দেন, যা প্রকল্প প্রাক্কলন থেকে অনেক বেশি।
ভারতের এক্সিম ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি এলওসিতে ৭৩৬ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। এর বাইরে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ৫০ কোটি ডলারের সামরিক কেনাকাটা-সংক্রান্ত একটি ঋণচুক্তিও হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে।
গত কয়েক বছরের ছাড়ের চিত্র
ভারতীয় ঋণ সবচেয়ে বেশি ছাড় হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। ওই বছর সব মিলিয়ে ৩৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার ছাড় করেছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। এর আগের বছরে ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৩২ কোটি ৭৮ লাখ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০২০-২১ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ কোটি ডলার করে ছাড় হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১৬ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে।
এ বিষয়ে ইআরডির এশিয়া শাখার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলছে রাজি হননি। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকে বেশ শ্লথগতিতে অর্থ ছাড় হতো। ধীরে ধীরে অর্থছাড় বাড়ছে। শর্ত শিথিল হওয়ায় এখন অর্থছাড়ও দ্রুত হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও ছাড় বাড়বে। তাঁরা আরও বলেন, ভারতীয় ঋণে যেসব সমস্যা আছে, তা সমাধানে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিক সভা হয়েছে।
কী ধরনের প্রকল্প
বর্তমানে ভারতীয় ঋণে আটটি প্রকল্প চলমান। এই আট প্রকল্পে সব মিলিয়ে ৩০৪ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে ভারত। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পই পরিবহন খাতের। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে রেলপথ ও সড়ক নির্মাণ এবং সড়ক মেরামতের যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে।
পরিবহন খাতের প্রকল্পগুলো হলো খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ; ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণ; কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ সংস্কার, আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা এবং সড়ক মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণে যন্ত্রপাতি কেনা। তবে খুলনা–মোংলা রেলপথ চালু করা হয়েছে। আগামী অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটি শেষ হবে।
এর বাইরে অন্য তিন প্রকল্প হলো রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা; ১২ জেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণ এবং বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি লাইন প্রকল্প।
এক্সিম ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতা বাংলাদেশ
ভারতের এক্সিম ব্যাংক প্রায় দুই দশক আগে প্রথম এলওসি ধারণা নিয়ে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়া শুরু করে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু। ব্যাংকটি ভারতের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে ঋণসহায়তা দেয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অনুদানসহ ১০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট পায়।
এরপর গত এক যুগে বাংলাদেশ এক্সিম ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা দেশে পরিণত হয়। এক্সিম ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার তালিকায় আরও আছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, কিউবা, নাইজেরিয়া, সিরিয়া, মিয়ানমার, সেনেগাল, কঙ্গো, ঘানা, আইভরি কোস্ট, অ্যাঙ্গোলা প্রভৃতি দেশ। এসব দেশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৮১৫ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের। এর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ৩২ শতাংশ ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ।