খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল-এর কলম
গণতন্ত্রের পথেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষে দেশে ফিরে একেবারে মূল বার্তাটি দিয়েছেন—“বাংলাদেশকে এখন গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।” এটি নিছক কোনো দলের রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি জাতির বাঁচা-মরার প্রশ্ন। গণতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও এই গণতন্ত্রকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। বারবার একনায়কতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা পথ হারিয়েছি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে রাষ্ট্র পেলাম, তার মূল দর্শন ছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবাধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, ভিন্নমত দমন করা হয়, সংসদীয় রাজনীতি স্তব্ধ হয়ে যায়। এভাবে প্রথমবার গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তখন দেশের রাজনীতি ও প্রশাসন ছিল প্রায় অচল অবস্থায়। সেই সময়ে জিয়াউর রহমানের নেওয়া ঐতিহাসিক পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন, গণমাধ্যমকে কিছুটা স্বাধীনতা দেন, আর জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনেন।
১৯৭৮ সালের গণভোট ও ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন জনগণকে দীর্ঘদিন পর অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির স্বাদ দেয়। জিয়াউর রহমানের সাংবিধানিক সংস্কার বিশেষ করে রাজনৈতিক বহুমতের স্বীকৃতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সংরক্ষণ আজও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি হয়ে আছে। তাঁর সময়কার ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ আজ বিএনপির নয়, সমগ্র জাতির সম্পদ।
কিন্তু এই গণতন্ত্র টেকেনি। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। শুরু হয় দীর্ঘ নয় বছরের সামরিক শাসন। এরশাদের সময়ে গণতন্ত্রকে দমন করা হয়, রাজনৈতিক কর্মীরা কারাগারে যান, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, জনগণ কখনোই একনায়কতন্ত্র মেনে নেয়নি। ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে।
১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের রক্ত, অসংখ্য আন্দোলনকারীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতন ঘটে। এই গণআন্দোলন প্রমাণ করে—গণতন্ত্রকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করা যায়, কিন্তু চিরতরে হত্যা করা যায় না।
তবে দুঃখিনীর কপালে সুখ বেশি দিন থাকে না, ২০০৬ সালে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি হয়। দেশের ক্ষমতা চলে যায় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে, যেটি সামরিক প্রভাবিত ছিল। দুই বছরের এই শাসনামলে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার, মৌলিক অধিকার হরণ, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ—সবই হয়েছিল। যদিও উদ্দেশ্য ছিল “রাজনীতি শুদ্ধ করা”, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। জনগণের ভোটের অধিকার ছাড়া কোনো সরকারই টিকে না—এই শিক্ষা আবারও স্পষ্ট হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কয়েক বছরে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেলেও ধীরে ধীরে দেশ আবারও একদলীয় শাসনের দিকে ধাবিত হয়। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় যেটি ছিল জনগণের আন্দোলনের ফসল এবং সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র ব্যবস্থা। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচন হয় বিরোধী দলবিহীন, যেখানে অধিকাংশ আসনে ভোটাররা ভোটই দিতে পারেননি।
২০১৮ সালের নির্বাচন আরও কলঙ্কিত। ভোটাররা ব্যালটের কাছে যাওয়ার আগেই রাতে বাক্স ভরে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকরা এটিকে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ বলেছে। এখন বাংলাদেশে সংসদ কার্যত একদলীয়, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করা হয়, মামলা-হামলা-গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হয়ে গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিত্যদিনের ঘটনা।
লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ সবাই এক কণ্ঠে বলছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য সেই আন্তর্জাতিক প্রত্যাশার প্রতিফলন।
বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে শিক্ষা একটাই—গণতন্ত্র ছাড়া এই দেশ চলতে পারে না। জিয়াউর রহমান যে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটি আজও আমাদের মুক্তির পথ। এরশাদের পতন কিংবা ১/১১ সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে, জনগণ ছাড়া কোনো শাসন টেকসই নয়।
আজ সময় এসেছে—একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাস, এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ।
সব শেষ কথা এটাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি, কিন্তু আবারও উঠে দাঁড়িয়েছি। এখন আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেই হবে। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
কারণ, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, তারা টেকেনি; কিন্তু গণতন্ত্র চিরকাল বেঁচে থেকেছে জনগণের হৃদয়ে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল একটি পথেই নিহিত—গণতন্ত্রের পথে।